সব শুরুই কেমন সুখের, সব ফুরিয়ে যাওয়াও কেমন দুঃখের। তুষার সাহেবদাদুর কথা ভাবল। সাহেবদাদু একেবারে শেষ বেলায় এসে পড়েছেন। এবার ডুবে যাবেন। কী হবে তখন শিশুতীর্থের? জ্যোতিবাবু কর্তা হবেন। জ্যোতিবাবু দায় দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সাহেবদাদুর অত সাধের শিশুতীর্থকে চালাবেন। পারবেন কি? হয়তো পারবেন। জ্যোতিবাবুর না পারার কারণ নেই। তিনি জীবনে অন্য কিছু কামনা করেন না। আর করলেও সেই কামনা বড় কিছু নয়। হয়তো মলিনাকে বিয়ে করলে সে কামনাও মিটবে।
আশাদি কথাটা বলেছে তুষারকে। বলেছে, মলিনার ওপর জ্যোতিবাবুর যেমন টান তুষার, তাতে মনে হয় মেয়েটাকে জ্যোতিবাবুই বিয়ে থা করবেন।
কথাটা তুষার বিশ্বাস করতে চায় না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও নয়। মলিনাই বা কেমন? আদিত্যর সঙ্গে তার মেশামিশিতে আটকায় না, আবার জ্যোতিবাবুর মায়া মমতাটুকুও সুযোগ বুঝে নেওয়া চাই। ওই মেয়েটাকে তুষারের কোনও দিনই ভাল লাগে না। নামই মলিনা নয়, ওর মনও বড় মলিন।
ভাবতে ভাবতে তুষারের চোখে তন্দ্রা জমেছিল। কয়েকবার চোখের পাতা খুলে সে দুপুরের দিকে চেয়ে থাকল, সতর্ক হল, ঘুমোতে চাইল না। তবু কখন তন্দ্রা এসে তার চোখের পাতা জুড়ে দিল। তুষার বালিশের কোলে মাথা মুখ চেপে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
ঘুম ভাঙল বিকেলে। রোদ পালিয়েছে। বিকেলের রং ঘন হয়েছে, বাগানের চেহারা নিরুজ্জ্বল। রোদের কিরণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার আঙুলগুলো যেন ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবার ঘরে ঢুকবে। তুষার ধড়মড় করে উঠে বসল। শিশিরের ঘরে কার যেন গলার শব্দ।
বাইরে এসে তুষার কলঘরে গেল। বেরিয়ে এসে আকাশ দেখল, রোদের ঈষৎ আভা আকাশের তলায় লেগে আছে। একটা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নিচু দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। চোখ মুখের জল আঁচলে মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে তাকাল তুষার। বাইরে কুয়োতলার কাছে ঝিয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। অবেলার ঘুমের জন্যে হাই উঠছিল তুষারের। ইস সেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তুষার। মাথাটা অবশ্য এখনও ভার লাগছে না।
শিশিরের ঘরের কাছে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে শেষে তুষার ঘরে ঢুকল। যতীন।
তুষারকে দেখে যতীন বলল, এই যে দিদি, আপনি গিয়েছিলেন শুনলাম। আমি দুটোর পর ফিরেছি। স্নান খাওয়া করে এলাম। বলে যতীন একটু লজ্জার হাসি হাসল, বলল, শিশিরের কাছে শুনলাম। আমার জিপ অচল। কাল সকালে আপনাকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব।
কাল।
খুব সকালেই পাবেন। জিপটার ব্রেক ধরছে না ঠিক মতন। সারতে লাগিয়ে দিয়েছি।
তবে তাই। সকালেই পাঠিয়ে দিয়ে। আমার বেশি দেরি হবে না। তুষার হাসল।
যতক্ষণ খুশি আপনি আটকে রাখবেন। কাল থেকে আমার চার পাঁচটা দিন নো-ওয়ার্ক। যতীন হাসল।
যতীনের বয়স বেশি নয়। চেহারাও ভাল। কাঠগোলার ব্যবসায় দু পয়সা মন্দ করছে না। ছেলেটি ভাল, ভদ্র, বিনীত। তুষারের হঠাৎ ইতির কথা মনে পড়ল। যতীনের কথা সাহেবদাদুকে বললে হয়।
চা খেয়েছ? তুষার শুধোল।
খেয়েছি।
কী ঘুম ঘুমোলি তুই। শিশির বলল তুষারের দিকে তাকিয়ে, এই রেটে গোটা ছুটি ঘুমোলে মোটা হয়ে যাবি।
তুষার ভাইকে দেখল। শিশির তাকে ডেকে দিতে পারত। ডাকেনি। দিদির ওপর কত মায়া! হাই আসছিল তুষারের আবার, মুখে হাত আড়াল দিয়ে তুষার হাই তুলল, বলল, সারা বছর কাজ করি, ছুটিতে একটু ঘুমোব না? ..যাক গে, চা খাবে আর একটু যতীন?
খাবে। তুই তৈরি করে নিয়ে আয় তো! শিশিরই জবাব দিল।
রান্নাঘরে চলে গেল তুষার। স্টোভ ধরিয়ে চা করল। অবেলার ঘুম বড় আলসামি মাখিয়ে দেয় সারা গায়ে। তুষারের সর্বাঙ্গে সেই আলস্য, যেন তুলোর মতন কোমল, মনে হয় আবার গিয়ে বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকি। শুয়ে থেকে থেকে সন্ধ্যাকে দেখি, দেখি রাত কেমন করে আসে, কেমন করে সেই রাতের মধ্যে ডুবে যাই।
শিশিরদের চা দিয়ে, নিজে চা খেয়ে তুষার যখন রুক্ষ চুল নিয়ে বসেছে, তখন সন্ধে হয়ে আসছিল। আর ঠিক সন্ধের মুখে আদিত্য এল। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে।
তুষার অবাক। মানুষটা এ-ভাবে এসেছে কেন? সে কি আজও যাবে না? ব্যাপার কী?
শিশিরের ঘরেই বসেছিল আদিত্য। কথা হচ্ছিল শিশিরের সঙ্গে। তুষার বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গেছেন।
কাল যাব। ..আদিত্য বলল, আজ একবার লাস্ট ভিজিট সেরে নিচ্ছি।
শহরে আর কার সঙ্গে দেখা করতে আসবে আদিত্য। তুষারের ইচ্ছে হল পরিহাস করে বলে, মলিনার সঙ্গে দেখা হল? অথচ মনে মনে কোনও সাড়া পেল না তুষার। বলল না। মলিনাকে শেষ দেখা করার লোক বলে ভাবতেও পারল না।
কথাটা শিশিরই পাড়ল হঠাৎ। বলল, দিদি, তুই তো সঙ্গী পেয়ে গেলি।
সঙ্গী! তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল অবাক চোখে। আদিত্যবাবু তাঁর রথ নিয়ে এসেছেন। শিশির হাসিমুখে ব্যাখ্যা করল। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, দিদি শিশুতীর্থে যাবার জন্যে সকাল থেকে জ্বালাচ্ছে। আপনিই নিয়ে যেতে পারেন।
তুষারের ইচ্ছে হল শিশিরের মুখের কথা কেড়ে নেয়, থামিয়ে দেয়। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই না কি ওর! অত দরদ দেখাবার কী দরকার পড়ল শিশিরের! তুষার বিরক্ত বোধ করে শিশিরের দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। তুষার পাগল হয়নি। ওই মানুষের সঙ্গে পথে বেরিয়ে কি সে আরেক জ্বালার মধ্যে পড়বে না কি! না। শিশিরের কথার পর-পরই তুষার আপত্তি জানাতে গেল, না না, এখন নয়। সকালে যাবার দরকার হয়েছিল একটু!