হ্যাঁ বলছিলাম। তোর মুণ্ডু।
কথাটা খুব অসত্য নয়। মেতিপাতা বাটলে যেমন রং হয়, তেমনই লাল রঙের লম্বা ডুরে দেওয়া একটা শাড়ি ইতির জন্যে কিনেছিল তুষার। কিন্তু শাড়িটা তার নিজেরই পছন্দ ছিল। শিশিরকে দেখাবার সময় বলেছিল, শাড়িটা আমায় কেমন মানাবে বল তো! শিশির রং দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, দিদির গায়ের রঙের সঙ্গে যে চমৎকার মানাবে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না; শিশির বলেছিল, তোকে ওয়ান্ডারফুল মানাবে।
তুষারের মন দীন নয়, তবু আশ্চর্য যে, তুষার সহসা যেন এই সুন্দর শাড়িটা নিজের জন্য রাখার লোভ করেছিল। বলেছিল, ইতির জন্যে তবে অন্য একটা আনতে হয়।
মনে মনে তুষার কি এই দ্বিধাবশত শাড়িটা ইতির জন্যে নিয়ে যেতে ভুলে যাচ্ছিল! তুষার কি অকস্মাৎ কোনও কারণে নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েছে? না। তুষার পরে মাথা নেড়েছে, এবং তার এই ছেলেমানুষি লোভ ও চিত্ত দীনতাকে শাসন করে নিয়েছে।
একটা উপায় বল তো তুষার ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইল।
শিশির ভাবল। বলল, তুই না ছেলেবেলায় একবার সাইকেল চড়া শিখেছিলি।
ইয়ার্কি করিস না–তুষার রাগ করে বলল।
তবে হেঁটে যা।
খুব বললি!
শিশির নীরব হল। তার মাথায় এমন কোনও বুদ্ধি এল না, যাতে দিদিকে নিশ্চিত করতে পারে।
তুষার ভাইয়ের ঘাড়ে যেন সব দোষটা চাপাবার চেষ্টা করে বলল, তোর জন্যেই এরকম হল।
আমার জন্যে!
না তো কী! এ কদিন শুধু ঘর দোর পরিষ্কার, চুনকাম করানো–এসব দেখতে গিয়ে আর সময় পেলাম কই। নয়তো নুটুর সঙ্গে গিয়ে কাজটা সেরে আসতাম। তুষার কিছুটা ক্ষুণ্ণ যেন।
শিশির বলল, দেখ দিদি, তুই এক কাজ কর। পোস্ট অফিসের কাছে যতীনের বাড়ি। যতীনকে গিয়ে বল, ব্যবস্থা করে দেবে।
তুষার যতীনকে চেনে। শিশিরের বন্ধু যতীন। কাঠগোলার মালিকের ছেলে। মাঝে মাঝে তাদের জিপগাড়ি বন জঙ্গলে যায় কাঠ কাটা তদারক করতে। তুষার বললে যতীন যে একটা ব্যবস্থা করে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। সামান্য নিশ্চিন্ত হল তুষার।
.
আরও একটু বেলায় তুষার যতীনদের কাঠগোলায় গেল। যতীন নেই কাজে বেরিয়েছে, ফিরতে দুপুর হবে। তুষার ফিরে এল।
নুটুর গাড়ি আজ আসবে না। যদি আসার হত সকালেই আসত। বিকেলে কি আর আসবে। জ্যোতিবাবু বাড়ি আসবেন আজ বিকেলেই হয়তো, কিন্তু তিনি সাইকেল নিয়ে আসবেন, গাড়ি নিয়ে নিশ্চয় নয়। তুষার ভেবে দেখল, তার পক্ষে অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই। যদি কোনও কাজে কর্মে নুটু এসে পড়ে গাড়িটা নিয়ে ভাল, নয়তো কাল যখন ইতি আর আশাদিকে নিয়ে নুটু ঠাকুর দেখাতে আসবে তখনই যাবে তুষার। উপায় কী!
আজ দুপুরটা অজস্র সময় আর কর্মহীন অবসর নিয়ে এসেছিল। তুষার অনুভব করল তার চারপাশে অফুরন্ত আলস্য দীঘির মতন বিরাজ করছে। এখানে শরৎ কাল বাংলা দেশের মতন নয়, কিন্তু এই শরৎ আরও শুষ্ক, যেন শীতের মিশেল দেওয়া। রোদ ঠিকরে আছে, আকাশ সুনীল, বাতাস মৃদু ও শীতল। বাগানে কয়েকটা প্রজাপতি আপন মনে উড়ছে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ তুষার এই দুপুরকে অনুভব করল। আজ অনেকটা বেলায় সে মাথা ঘষেছে, চুলগুলো এখনও সামান্য ভিজে। রোদে দাঁড়িয়ে তুষার চুল শুকিয়েছে যতটা পেরেছে, তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি, রোদটা কপালে লাগছিল। তা ছাড়া, আরও কিছু যেন লাগছিল।
তুষার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কেমন বিষণ্ণ মনে করেছিল। কোনও কারণ নেই, তবু শান্ত নিবিড় দুপুরে, যখন আকাশের তলায় কয়েকটা চিল ডানা মেলে উড়ছে, পাকা হরীতকীর মতন রং ধরা শূন্যতা চারপাশে, অলস কাক কোথাও বসে ভাবছে এবং শিউলি গাছটার তলা থেকে কদাচিত বাতাসে গন্ধ ভেসে আসছে–তখন তুষার অনুভব করল তার কোথাও যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষার সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি জ্যোতিবাবুর কথা ভাবল। মলিনার কথাও। কিন্তু এদের ভাবনার মধ্যে তুষার নিজের মনকে ডুবিয়ে রাখতে পারল না। আদিত্যর কথা তার বার বার মনে পড়ছিল।
আদিত্য এখনও যায়নি। তার যাবার কথা তুষার শুনেছে। গতকালই তার চলে যাওয়া উচিত ছিল। যায়নি। গেলে দেখা হত, আদিত্য দেখা করত। কেননা নুটুর গাড়ি ছাড়া উপায় নেই যাবার। আর নুটুর গাড়ি কালও এসেছে তুষারের বাড়িতে। আদিত্যর যাওয়ার কথা কেউ বলেনি।
আদিত্যর কথা ভাবতে ভাবতেই তুষার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। শিশিরটা ঘুমোচ্ছে। বিছানায় শুয়ে তুষারেরও ঘুমোতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সাহস হল না। অতক্ষণ মাথা ঘষার পর দুপুরে ঘুমোতে ভরসা পাচ্ছিল না, বিকেলে মাথা ভার হবে, সর্দিও হয়ে যেতে পারে। তুষার না ঘুমিয়ে শিশিরের ঘর থেকে একটা মাসিক পত্রিকা এনে শুয়ে পড়ল।
একটা গল্প পড়ল তুষার। ভাল লাগল না। পাতা ওলটাল এ-লেখা সে-লেখায়, মন বসল না। পাতা উলটে উলটে বিজ্ঞাপন দেখল। তারপর পত্রিকাটা রেখে দিল।
অবশেষে জানলা দিয়ে মরে আসা দুপুর দেখতে লাগল। দুপুর ফুরিয়ে আসছে দেখলে কেমন মায়া হয়; মনে হয় যে সকালটি সুশোভিত হয়ে দেখা দিয়েছিল, তার যাবার বেলা হয়ে এল। আর এসব কথা মনে পড়লেই কেন যেন অলস মন যত অদ্ভুত চিন্তা করে। চিন্তা করে যে, সব জিনিসই ফুরিয়ে আসে, সব জিনিসেরই পরিণাম আছে। যেমন করে সকাল ফুরোল, এমনি করেই শরৎ ফুরিয়ে আসছে, শীত আসবে তাও ফুরোবে। তুষারও ফুরিয়ে আসছে। আশাদির মতন।