আশালতা পাথুরে মাটি শব্দটার অর্থ বুঝেছিল। তার মনে হয়েছিল, সাহেবদাদু সংসার থেকে পালাতে গিয়েও ফিরে এসেছেন বলে মাঝে মাঝে যেন স্নেহবশে এই সংসারকে তিরস্কার করেন।
আশালতা কোনও জবাব দিতে পারে না। ইচ্ছেও করে না কিছু বলতে। মন কেমন বিষণ্ণ অথচ গভীর মমতায় সিক্ত হয়ে আসে। নীরবে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
সাহেবদাদু যে শিশুটিকে এনেছিলেন, একদিন সে সাহেবদাদুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে:
তখন চৈত্র মাস। চাকরটার তাপ-জ্বর; সে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। রোদের তাত সামান্য পড়ে আসতেই সাহেবদাদু তাঁর টমটম হাঁকিয়ে শহরে ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন। শেষ বেলায় আচমকা ঝড় উঠল। ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী। আকাশ কালো করা সেই দৈত্যকায় ঝড় এত ভীষণ চেহারা নিয়ে দেখা দিল যে, শিশুটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে সঙ্গী খুঁজছিল। তার কোনও সঙ্গী ছিল না, বুড়ো চাকরটা জ্বরে বেঘোর। এই জনহীন প্রান্তর ঝড়ের গর্জনে ভরে গেছে, চারপাশ নিকষ কালো, গাছপালা গা মাথা লুটিয়ে মাটিতে আঁচড়াচ্ছিল, বাতাসের বেগ শাখা-প্রশাখা ভাঙছিল। ভীত শিশু তার একমাত্র সঙ্গী চাকরটার কাছে গিয়ে গা আঁকড়ে বসেছিল। কিন্তু জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ মানুষটা কোনও কথা বলতে পারেনি, কোনও সাহস সান্ত্বনা দিতে পারেনি, এমনকী চোখের পাতা খুলে তাকিয়ে থাকাও তার সাধ্যাতীত ছিল।
সাহেবদাদু যখন ফিরে এলেন তখন ঝড় থেমেছে, চাকরের ঘরে শিশুটি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে বিছানার পাশে। ওকে মৃত দেখাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল বীভৎস এবং ভয়ংকর কিছুর সংস্পর্শে এসে সে অসহায়ের মতন কোনও অবলম্বন খুঁজেছিল, পায়নি; না পেয়ে শেষাবধি এই ভাবে কোণঠাসা হয়ে মরেছে।
ওর নাম ইতি। ওর আট বছরের জীবনে সেদিন ছেদ পড়তে পারত। পড়েনি। সাহেবদাদু ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন বলেই সঙ্গে তাঁর প্রয়োজনীয় মানুষটি ছিল। ইতি সে-যাত্রা বেঁচে গেল। কিন্তু মেয়েটার মনে সেদিনের আচমকা ভয় কোথায় যেন একটা অসাড়ত্ব এনে দিল। সে একা থাকতে চাইত না, একা শুতে পারত না, ফাঁকায় তার গা ছমছম করত।
সাহেবদাদু বুঝেছিলেন, মেয়েটার সঙ্গী দরকার। তাঁর বা বিষ্ণুর সঙ্গ যথেষ্ট নয়।
তোর মাসির কাছে যাবি? সাহেবদাদু ইতির মনের ভাব বোঝবার চেষ্টা করলেন।
না।
মাসিকে তোর মনে আছে?
নেই।
তবে?
কিচ্ছু না।
ইতির কথা–ইতির সঙ্গীর কথা চিন্তা করতে করতেই একদিন সাহেবদাদুর খেয়াল হল, কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা জুটিয়ে এনে এখানে একটা পাঠশালার মতন খুললে কেমন হয়। সাহেবদাদুর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু মানুষ নতুন কোনও খেলা শিখলে যেমন নেশায় জড়িয়ে যায়, উনি অনেকটা সেই ভাবে জড়ালেন।
ছ বছর আগে একটি মাটির ঘরে শিশুতীর্থের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পাঁচ-ছটি ছাত্র। চারটি ছাত্র তিনি জোগাড় করেছিলেন মাইল দেড়েক দূরের গ্রাম থেকে, তারা আদিবাসী, ক্রিশ্চান। আর দুটি আসত শহরের কাঠ কারখানার মালিকের বাড়ি থেকে, মটর বাইকের সাইডকারে। কাঠ কারখানার মালিক সাহেবদাদুর প্রতি শ্রদ্ধাবান এবং অনুরক্ত ছিলেন বলেই যেন সাহায্য করেছিলেন নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে শিশুতীর্থে পাঠিয়ে।
একথা বোঝাই যায়, অজায়গায় এমনি একটি কোমল লতা রোপণ করেছিলেন সাহেবদাদু যা রক্ষা করা ও বর্ধিত করা খুবই কষ্টকর। যে কোনও সময় শুকিয়ে যেতে পারত সে সম্ভাবনা সর্বদাই ছিল। কিন্তু সাহেবদাদুর প্রাণান্ত চেষ্টায় কয়েকজনের সাহায্যে লতাটি শুকোয়নি, বেঁচে গেছে। ছ বছরে তার যেটুকু বৃদ্ধি ও বিস্তার তা নিতান্ত কম নয়।
সামান্য আর কয়েকটি কথাও বলতে হয়। যে বয়সে সাহেবদাদু তাঁর জীবন এই দুরূহ কর্মে উৎসর্গ করেছিলেন, সে বয়স উদ্যমের নয়। অবশিষ্ট শক্তিটুকু ছিল আয়ুকে কোনও রকমে রক্ষা করার জন্যে। উনি সেই শক্তিকে কর্মের জন্যে ব্যয় করে খুব দ্রুত আয়ুকে ফুরিয়ে আনলেন। এখন এই মানুষটির কাছে সেসব কল্পনা, যে কল্পনা জাফরি কাটা জানলার রৌদ্র ছায়ার মতন অস্পষ্ট ও মেদুর, তেমন কল্পনা অবলম্বন করে পড়ে আছেন। হয়তো তিনি দেখতে পান, শিশুতীর্থে খুব বড় একটা মেলা বসেছে, মুখর হয়ে উঠেছে সর্বত্র, কলরবে এ নির্জনতা পূর্ণ, শত শিশুর চরণের ধুলোয় ধুলোয় গাছের পাতা ধূসর হয়ে গেছে, ঘাসের ডগাগুলো দলিত, দূর থেকে একজোড়া ছেলে-মেয়ে ছুটে আসছে, রোদের খর আলোয় মুখগুলো দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো, ছুটতে ছুটতে তারা পলাশ গাছটার তলা দিয়ে সামনে চলে এল, সাহেবদাদুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ওদের হাতে মুঠো ভরা ফুল…
দৃশ্যটা হঠাৎ যেন রোদের ছটায় ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়। সাহেবদাদু চোখের পাতা বুজে বসে থাকেন।
.
০৩.
আজ সকালেও কালকের রাত্রের প্রকাণ্ড মেঘটার কিছু অবশেষ ছিল। যেমন ঘুম ভাঙার পরও ঘুমের রেশ, তেমনি রেশ ছিল বাদলার। অল্প পরেই টুটে গেল। ঝকঝকে রোদ ছড়াল মাটিতে। আকাশ বোয়া মোছা উঠোনের মতন নিকানো।
মাসটা আশ্বিন। এই সবে আশ্বিন পড়েছে। বৃষ্টি-বাদলের পালা ফুরোচ্ছে। একটু-আধটু শরতের বর্ষণ থাকবে কিছুদিন। নুটুর মনে তেমন আর উদ্বিগ্নতা নেই। এইমাত্র তার গাড়ি এসে থামল শিশুতীর্থর ফটকে।
তুষার নীচে নেমে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েগুলো নামছিল হুড়োহুড়ি করে, কাউকে কাউকে হাত ধরে নামিয়ে দিচ্ছিল তুষার। কলকণ্ঠে ভরে উঠল জায়গাটা। যেন এক ঝাঁক পাখি হঠাৎ উড়ে এসে এখানের মাঠে নেমেছে।