তুষার বিস্মিত হয়ে চোখ তুলল। সবটাই তো আপনার টাকা। জানি।
আমার শ খানেক হলেই চলবে। পুজোর পর রাঁচির দিকে একটা স্কুলে যাব। মিশনারি স্কুল। কোনও খরচা নেই। আদিত্য ধাঁধার মতন বলছিল, আমায় একশোটা টাকা দিয়ে দেবেন।
তুষার কিছু বুঝতে পারছিল না। মানুষটা পাগলামি করছে! বাকি টাকা কি ওর জন্যে জমা করে নিয়ে বসে থাকবে তুষার। বাকি টাকা? তুষার প্রশ্ন করল।
দান করে দিলাম। অবহেলার গলায় বলল আদিত্য।
দান!
ডোনেশান। …দু তিনটে গোরু কিনে নেবেন টাকাটায়।
গোরু! তুষার বিস্মিত।
গোরু ভাল জিনিস। একটা গোয়ালঘর করে রেখে দেবেন। দুধ-টুধ হবে বাচ্চাদের খাওয়াবেন। আদিত্য ঠাট্টা করছিল না, নাকি বিদ্রূপ, অথবা সত্যিই সে গরু কেনার প্রস্তাব দিচ্ছিল, তুষার কিছু বুঝতে পারল না। আদিত্য আবার বলল, মিলক ইজ গুড ফর হেলথ। বলে হাসতে লাগল।
তুষার বুঝতে পারল সমস্তটাই বিদ্রূপ। রাগ হল তুষারের। বলল, এখানে কী ব্যবস্থা করা হবে তার ভাবনা আমরা ভাবব।
আদিত্য কথাটা শুনল, গ্রাহ্য করল না। বলল, টাকাটা সত্যিই আমি আপনাদের ফান্ডে দিলাম। আমার এখন প্রয়োজন নেই। …গোর না কিনতে চান কিনবেন না, যা খুশি করবেন।
আদিত্য দু হাত মাথার ওপর তুলে আলস্য ভাঙল। হাই তুলল। কাল একেবারে ঘুম হয়নি। আজ দুপুরে একটু ঘুমোতে হবে। চলি।
চলে গেল আদিত্য। তুষার দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটা কি সত্যিই তিনশো টাকা দান করে দিল। খেয়াল নাকি? তোক দেখানো দম্ভ। দম্ভ হলে এতদিন কেন টাকাটা দেয়নি!
তুষার আবার আশাদির বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, মানুষটা বোধ হয় কিছুটা ছেলেমানুষ, কিছুটা খেয়ালি। না, ওর কোনও দম্ভ নেই। অথচ দম্ভ দেখালে বেমানান হত না। যতই তুমি অপছন্দ করো, তবু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, ও বিদেশ ঘুরেছে এই শিক্ষাপদ্ধতি দেখে বেড়াতে, ও না জানে এমন বিষয় বোধ হয় শিশুশিক্ষার মধ্যে নেই। লোকটাকে অশিক্ষিত বলা চলে না।
কয়েক পা এগিয়ে এসে তুষারের হঠাৎ মনে হল আচ্ছা–আদিত্য, সাহেবদাদু যদি আদিত্যের সঙ্গে ইতির বিয়ে দেন, কেমন হয়! বয়সে একটু বেমানান, কিন্তু স্বভাবে কি খুব বেমানান হবে! দুজনেই ছেলেমানুষ।
কথাটা ভাবতে তুষারের কেমন ভীষণ হাসি পেল। আদিত্য ইতির স্বামী, ইতি আদিত্যের স্ত্রী। আর তখন, আদিত্য শিশুতীর্থ-য় সর্বেসর্বা। তার ধমকে তার কথা মতন তুষারদের চলতে হবে।
আদিত্য তখন নিশ্চয় তুষারকে আর কাজ করতে দেবে না। তাড়িয়ে দেবে। তুষারের ওপর গায়ের জ্বালা কি তখন না মিটিয়ে পারবে আদিত্য।
এই কাল্পনিক অকারণ চিন্তা তুষারকে কেমন ম্রিয়মাণ করল। তার ভাল লাগল না ভাবতে। আদিত্যকে ইতির স্বামী হিসেবে যেন তুষার পছন্দ করতে পারল না।
.
১৪.
শিশুতীর্থ বন্ধ হয়েছে। পুজোর ছুটির বন্ধ। জ্যোতিবাবু আর আশাদির এখনও ছুটি হয়নি। যে ছেলেগুলো শিশুতীর্থর মধ্যে থাকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছে ওরা। কাছাকাছি। জায়গার ছেলে ওরা–বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে বাড়ি; এক একটা দল করে ট্রেনে বোডবাসে পৌঁছে দিতে হচ্ছে কচিগুলোকে। দুতিনদিনের মধ্যে শিশুতীর্থ খালি হয়ে যাবে, থাকার মধ্যে সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি আর দু একজন ঝি চাকর আর নুটু।
ছুটি শুরু হবার পর চারটে দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। এবার আশ্বিন শেষ করে পুজো। অর্থাৎ এই পুজো কেটে গেলেই কার্তিকের গোড়ায় হেমন্তকাল শীতের ছোঁয়া দিতে আসবে।
তুষার কটা দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করল। পুজোর আগে প্রতিবার তার এই এক খাটুনি। সমস্ত বাড়ি, প্রতিটি জিনিস নিজের হাতে পরিচ্ছন্ন করবে। শিশির বলছিল বলে, এই ঘরদোর ধোওয়া মোছর সঙ্গে অন্য খাটুনিও জুটল চুনকাম করানোর হাঙ্গামা।
বাড়ি ঘর তকতকে করিয়ে তুষার যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তখন বোধনের বাজানা বেজে উঠেছে।
সকালে চা খেতে খেতে শিশির বলল, তুই না তোদের শিশুতীর্থতে যাবি বলছিলি একবার।
হ্যাঁ রে, একবার যেতে হবে। আজ ষষ্ঠী হয়ে গেল। ইতিকে কাপড়টা দিয়ে আসতে হবে পুজোর।
যাবি কী করে? শিশির শুধোল।
তাই তো ভাবছি।
কালও নুটু এসেছিল, ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই পারতিস।
নুটু এত দিন তার গাড়ি নিয়ে রোজই এসেছে। জ্যোতিবাবু আর আশাদি ছেলেদের পৌঁছতে যাচ্ছে, ফিরছে; নুটুর গাড়িও তাই যাচ্ছে আসছে। কাল শেষবারের মতন এসে গেছে নুটুর গাড়ি; আজ আসবে কি না কে জানে। তুষারের খেয়াল ছিল কালকেও, কিন্তু নুটুর হাত দিয়ে ইতিকে পুজোর শাড়ি পাঠাতে তার মন চায়নি। তা ছাড়া তুষার সাহেবদাদুর জন্যে একজোড়া কার্পেটের চটি বুনেছে অনেকদিন থেকে, ইচ্ছে ছিল এবারে নিজে গিয়ে সাহেবদাদুকে দিয়ে আসবে।
নুটুর গাড়ি অবশ্য শহরে আবার আসবে। ইতিকে আশাদিকে নুটু শহরের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কি আর আজ আসবে? এলেও তখন ইতিকে কিছু দেওয়া ভাল দেখাবে না।
কবে কিনেছি–তুষার আপন মনে বলল, নিয়ে যাব যাব করে ভুলে গেলাম।
শিশির হাসল। বলল, তোর দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই অত ভুল।
বাজে কথা বলিস না।
বাজে কথা কেন! শাড়ি তোরও খুব পছন্দ ছিল রে। শিশির হাসছিল।
তাতে কি, পছন্দ হতেই পারে। তা বলে ইতির নাম করে কিনে আমি নিজে নেব।
আমি তার কী জানি! তুই-ই বলেছিলি।