একটি অল্পবয়সী ভাল ছেলে পেলে আমি ইতির বিয়ে দিয়ে দিতাম। সাহেবদাদু বললেন হঠাৎ।
তুষার চমকে উঠল। এত অল্প বয়সে!
ষোলো বছর। খুব কম আর কোথায়! সাহেবদাদু চিন্তিত মুখে বললেন, পারলে এটাই ভাল হত, তুষার। …যাক তোমায় বলা থাকল। তেমন কোনও খবর পেলে আমায় একটু জানিয়ে।
বেলা বাড়ছে। তুষার অল্প সময় দাঁড়িয়ে থেকে মাঠে নামল। ইতি তখনও রোদে। মাথার চুল শুকিয়ে নিচ্ছে। তুষার দাঁড়িয়ে ভাল করে আরও একবার দেখল ইতিকে। বেশ বাড়ন্ত দেখায়। তবু মুখের আদলে সেই কচি ভাবটা রয়ে গেছে ইতির। ওকে বিয়ে দিলে কেমন দেখাবে, ভাবতে তুষারের সকৌতুক হাসি পেল।
তুষারদি–ইতি কাছে এসে দাঁড়াল তুষারকে দেখতে পেয়ে।
তুষার স্নেহের চোখে দেখছিল। ইতির গায়ের রং যেমনই হোক, মুখ বড় মিষ্টি। নাক লম্বা পাতলা, ভুরু সরু, ঠোঁট পাতলা। এক মাথা চুল। তুষারের বড় ভাল লাগছিল দেখতে।
আজ তুমি যখন বাড়ি যাবে আমি একটু কাপড় দিয়ে দেব। ইতি বলল।
কীসের কাপড়?
জামার। তুমি কেটে এনে দিয়ো, আমি সেলাই করে নেব।
আমি সেলাই করতে পারি না? তুষার হাসিমুখে বলল।
তুমি তো কত ভাল পার! ..না, অত কাজের মধ্যে আর সেলাই করে দিতে হবে না তোমায়। আমি হাতে সেলাই করে নেব।
কাপড়টা তা হলে যাবার সময় দিয়ে দিস।
মাথা নাড়ল ইতি, দিয়ে দেবে কাপড়টা।
তুষার আশাদির বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
সাহেবদাদুর কথা ভাবছিল তুষার। ভেবে অবাক হচ্ছিল যে-লোক পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় এসে, কোন পাহাড়ের কোলে, বুড়ো বয়সে একটা স্কুল খুলে বসতে সাহস পেলেন, তিনি আজ একফোঁটা মেয়ের জন্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। ইতির বিয়ে দেওয়ার জন্যে সাহেবদাদুর এত দুশ্চিন্তা কেন! শিশুতীর্থ যতকাল আছে ততদিন ইতির আশ্রয় আছে, ভালমন্দ দেখার লোকও আছে। তবু সাহেবদাদু কেন এত ভাবছেন?
শিশুগাছের ছায়ায় তুষার একটু দাঁড়াল। অনেকটা দূরে আদিত্য। তুষার আদিত্যর টাকাটার কথা ভাবল। আজ আদিত্যকে বলতে হবে, টাকাটা আপনি তুলে নিন, আমার হিসেব রাখতে গোলমাল হচ্ছে।
আঁচলের আগায় গলা কপাল আলতো করে মুছে তুষার হাঁটতে লাগল।
ইতির জন্য সাহেবদাদুর ভাবনা যেন বেশি বেশি। এই বয়সে একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই কি সব সমস্যা ঘুচে যাবে। সাহেবদাদুর মনের অন্য দিকের জানালাগুলো যতই খোলা থাক–এ দিকে, তুষারের মনে হল, এদিকের জানলাটা কিন্তু বন্ধ। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়াকেই তিনি নিরাপদ বলে ভেবে নিয়েছেন। একটি পুরুষের হাতে একটি মেয়েকে সমর্পণ করলেই কি মেয়ের জীবনের সব সমস্যা মিটে যায়! তুষার স্বীকার করল, এতে মেয়েদের একটা আশ্রয় জোটে, বল-ভরসাও, কিন্তু সংসারে কি ইতির মাত্র সেইটুকুই প্রয়োজন? যদি তাই হয়, তবে ইতির আশ্রয়ের অভাব তো শিশুতীর্থে নেই, ইতির সুখ দুঃখের ভাবনা ভাববার লোক তো রয়েছে শিশুতীর্থে–জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার নিজেই। …তবে?
এসব ভাঙা যুক্তি, সাধারণ কথাবার্তা তুষারের পছন্দ হল না। সাহেবদাদু অত সামান্য বুদ্ধির মানুষ নন। ইতির মাথায় যে ছাদ থাকবে, ইতির দেখাশোনা করার লোক যে আছে–তিনি নিশ্চয় জানেন। তবু বিয়ের কথা ভাবেন যে, তার কারণ আছে। কারণটা তুষার অস্পষ্টভাবে অনুমান করতে পারছিল।
তুষার ভাবছিল, যাকে সোজা কথায় আশ্রয় বলা হয়–যাকে দায় দায়িত্ব ভার বলা হয়, তেমন আশ্রয় বা দায় দায়িত্ব বয়ে বেড়ানোর লোক মেয়েদের জীবনে অন্য ভাবেও জুটতে পারে; কিন্তু কোনও মেয়ের জীবন হয়তো এতে সম্পূর্ণভাবে আশ্রিত বা নিরাপদ, নিশ্চিন্ত অথবা নিরুদ্বিগ্ন থাকে না। ঘরবাড়ি খাওয়া পরার ভাবনা আপদ বিপদে দেখার লোক–এসব সাংসারিক প্রয়োজনের পরও নিশ্চয় মেয়েদের জীবনে অন্য প্রয়োজনও আছে। সেটা কী?
সেটা কী, তুষার ভাল করে ভাবতে পারছিল না। তবে অনুভব করতে পারছিল, ইতির যদি আজ বিয়ে হয়ে যায়, ইতি শুধু তার স্বামীর বাড়িতে থাকার, স্বামীর ছায়ায় নিশ্চিন্ত হবার, আহার বিহারের সুযোগ পাবে না–তার বেশি–অনেক কিছু বেশি হয়তো সেই জিনিসই পাবে, যাকে আমরা নিজের সুখ বলি। বা, তুষার ভাবল, হয়তো এই পাওয়াতে মেয়েদের এমন কোনও প্রাপ্তি আছে যা গভীর, যা পূর্ণ। হয়তো ইতিকে সাহেবদাদু এমন কোনও মানুষের হাতে দিয়ে যেতে চান–যার চেয়ে ঘনিষ্ঠ, যার চেয়ে অধিক আত্মীয়, যার চেয়ে ইতির সমস্ত মন প্রাণ সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্ক্ষার বেশি অন্য কেউ হতে পারবে না। সমস্ত জীবনের মতন ইতি তাকে পাবে, পাবে মৃত্যু পর্যন্ত।
ভাবনাটা তুষারের অনুভূতিকে কেমন রোমাঞ্চিত করল। যেন এই ভাবনার অজ্ঞেয় তাপ হৃদয়কে উষ্ণ ও কামনার্ত করল।
তুষার থমকে দাঁড়াল। সামনে আদিত্য। চোখ তুলে আদিত্যকে দেখল তুষার। এ কদিন তুষার আদিত্যর পাশ কাটিয়েছে। আদিত্যও তাকে উত্ত্যক্ত করতে আসেনি। আজ তুষার কী মনে করে সৌজন্যোচিত হাসি আনল মুখে।
আদিত্য হাসল না। তাকিয়ে থাকল।
আপনার টাকাটা নিয়ে নেবেন আজ। তুষার বলল।
টাকা! কীসের টাকা?
খেয়ালও নেই আপনার! তুষার চোখ ভরে আদিত্যকে দেখল, আপনার মাইনের টাকা। আমাদের কাছে পড়ে আছে।
কত টাকা?
আপনার হিসেব নেই?
না। কিছু টাকা আমি নিয়েছিলাম।
চারশো প্রায়।
শ খানেক আমায় দিয়ে দেবেন। মানে!