ইতিকে ওরা সবাই দেয়, জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার, প্রফুল্ল। মলিনা নয়। মলিনাটা যেন কী! কাণ্ডজ্ঞান নেই।
বারান্দায় উঠে সাহেবদাদুর মুখোমুখি দাঁড়াল তুষার।
কী খবর? কাজ হল? সাহেবদাদু প্রশান্ত মুখে তাকালেন।
হ্যাঁ, অনেকটা। তুষার সাহেবদাদুর চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। দু মুহূর্ত নীরব থাকল, সাহেবদাদুর কপালে ঘাম ফুটে আছে, তুষার বিনীত গলায় বলল, ওই টাকাটার কী হবে?
কোন টাকা?
আদিত্যবাবুর! উনি তুলে না নিলে হিসেব গোলমাল হবে।
নেয়নি টাকাটা? আমি তো আগেও বলেছি ওকে। সাহেবদাদু যেন সামান্য চিন্তিত হলেন, কী ভাবলেন অল্প সময়, বললেন, টাকাটা সরাসরি ওকে পাঠালেই পারে, আমাদের হাত দিয়ে ঘুরে যাবার যে কী দরকার আমি জানি না। …টাকাটা ওকে ডেকে দিয়ে দাও।
তুষার ঘাড় কাত করল। দিয়ে দেবে।
তুষার
আজ্ঞে
আমার চিঠিপত্রের মধ্যে একটা ড্রাফট পাবে। ব্যাঙ্ক ড্রাফট। জ্যোতিকে বলো ছুটির আগেই যাতে ভাঙিয়ে আনে। তোমাদের হাতে এখন কিছু না দিলে আমার খারাপ লাগবে।
মলিন করে হাসল তুষার। আমায় দিতে হবে না।
কেন? তোমার কি জমিদারি আছে? সাহেবদাদু তাকিয়ে থাকলেন।
আমার দরকার হলে আমি নিই।
এবারে না হয় এমনিই নাও। …সবাই মিলে তোমরা নাও, ওই ছেলেটিকেও দিয়ো। …
তুষার কোনও কথা বলল না। বলার প্রয়োজন ছিল না। সাহেবদাদু এমনি মানুষ। পুজোর আগে সবাইকে কিছু কিছু টাকা দিতে না পারলে তাঁর শান্তি নেই। এই টাকা হয়তো কর্জ করে এনেছেন, হয়তো তাঁর কোনও পুরনো সম্পত্তি বেচেছেন কী করেছেন কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। তবু তিনি দেবেন, না দিয়ে স্বস্তি পাবেন না।
তুষার চলে আসার জন্যে ফিরে দাঁড়াল। ইতি নেমে রোদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহেবদাদু আচমকা বললেন, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, তুষার। কদিনই ভাবছি। তুষার দাঁড়াল।
ইশারায় তুষারকে আরও একটু কাছে ডাকলেন সাহেবদাদু, তুষার পাশে এসে দাঁড়াল। খানিকটা সময় পরিপূর্ণ নীরব থাকলেন সাহেবদাদু, খুব যেন আত্মমগ্ন। শেষে মৃদুস্বরে বললেন, আমার আয়ু আর বেশি দিন নয়; আজকাল প্রায়ই রাত্রের দিকে বুকের মধ্যে কেমন করে। এমনিতেও বুঝতে পারছি, যাওয়ার দিন এল।
এমন শারদ দিনে, এই পুঞ্জিত রৌদ্র আর উদ্ভাসিত পূর্ব মধ্যাহ্নে সাহেবদাদুর শান্ত অথচ বিষণ্ণ আলাপ তুষারের ভাল লাগছিল না। তুষার বিষণ্ণ বোধ করল। সাহেবদাদুর চোখের দিকে তাকাতে পারল না। মনে হল, হয়তো সেই আসন্ন দুঃখকে সাহেবদাদুর মুখে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে।
অস্বস্তি বোধ করে তুষার বলল, আপনি যত অমঙ্গল ভাবেন।
অমঙ্গল ভাবি! যা সত্যি তাই ভাবা কি অমঙ্গল? সুন্দর একটু হাসি সাহেবদাদুর ঠোঁটে, যেন এই হাসি তুষারকে বলছে, ওরে এমনি করেই তো যেতে হয়।
তুষার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাক টানল, গায়ের আঁচল অকারণে নাড়ল, তারপর কয়েক পলকের জন্যে সাহেবদাদুর মুখ দেখল।
আমার ভাবনা ইতিকে নিয়ে। সাহেবদাদু বললেন নিশ্বাস ফেলে, ও আর ওর মাসির কাছে যাবে না। এই শিশুতীর্থর বাইরে ওকে পাঠানো মুশকিল। আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি, তুষার। ওর একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।
আর একটু বড় হোক, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। তুষার সহজ সাধারণভাবে বলল, সরল পথ দেখিয়ে দিল।
তোমরা কি চিরটা কাল এখানে কাটাবে, তুষার–! সাহেবদাদু চোখ স্থির রেখে তাকিয়ে থাকলেন, মুহূর্ত কয় পরে বললেন, আমি তোমাদের জীবনের সব নিতে পারি না। জ্যোতি হয়তো পারবে, আশাও পারতে পারে কিন্তু তোমরা পারবে না। …তোমাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে, শুধু শিশুতীর্থে পড়ে থাকলে চলবে কেন!
আমরা তো ভালই আছি। তুষার আড়ষ্ট গলায় বলল। সাহেবদাদুর কথা সে বুঝতে পেরেছে।
মেয়েদের ভাল সব দিক তাকিয়ে ভাবতে হয়–সাহেবদাদু বললেন, জ্যোতির কথা ধরো; সে পুরুষমানুষ। এই শিশুতীর্থর দায় নিয়ে তার আজীবন কেটে যেতে পারে। তার যদি সংসার করতে ইচ্ছে হয়, আটকাবে না কোথাও; কাজের সঙ্গে সংসারের বিরোধ হবে না। কিন্তু মেয়ে হলে কি পারত?
আশাদির কথা তুষারের মনে হল। ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে আশাদি তো মেয়ে, সেও কি পারবে না! কথাটা তুষার বলল না; সাহেবদাদু আশাদিকে বোধ হয় সংসারের সাধারণ পথ থেকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। কেন? আশাদির একটু বয়স হয়ে গেছে বলে! বয়স হয়ে গেলে কি মেয়েরা বিধবার মতন হয়ে যায়। মেয়েদের বয়সও কি এক ধরনের বৈধব্য। তুষারের চোখে আশাদির রঙিন শাড়ি পরা সেদিনের চেহারাটা ভাসছিল। দুঃখ হচ্ছিল তুষারের। দুঃখ হচ্ছিল, আশাদি নিজেকে বুড়ি সাজিয়ে রেখেছে বলে।
সাহেবদাদু বললেন, ইতির জন্যে আমার বড় ভাবনা, তুষার। তোমাদের ভরসা ছাড়া ওকে আর কোথায় বা রাখব অথচ তোমাদের ঘাড়ে এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যেতেও ইচ্ছে করে না।
তুষার নীরব থাকল। সাহেবদাদুর দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। সাহেবদাদুর অবর্তমানে ইতির দায় দায়িত্ব কে নেবে? জ্যোতিবাবু? জ্যোতিবাবু কি পারবেন? আশাদিও কি ওই মেয়ের সব ভালমন্দের ভার আজীবন বইতে পারবে? …তুষারের কেমন আচমকা মনে হল, মেয়েদের দায় বয়ে নিয়ে যাওয়া বড় কঠিন। অকূল নদীতে যাত্রী চাপিয়ে নৌকা বয়ে যাওয়ার মতন। কোনও স্থিরতা নেই, নির্দিষ্ট চিহ্ন নেই যে ততটুকু পৌঁছে দেবে। এই সমস্যা তুষারকে এখন কেমন বিহ্বল করল।