আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকল অল্পক্ষণ। সিঁড়ি থেকে নামল, ওপাশে আতাগাছের কাছে গিয়ে সাইকেলটা নিল। তারপর সাইকেল ঠেলে বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে তার দীর্ঘশ্বাস সে নিজের কানে শুনল। দাঁড়াল। আবার দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলল। আবার কান পেতে শুনল। আপন মনে বলল, সো সিলি এ হার্ট, নেভার নোজ লাভ, লাভ দ্যাট ইজ অ্যান আর্ট।
.
১৩.
আদিত্যর স্বভাব দেখে তুষার কয়েক দিন পরে আবার মনে মনে হাসল। নিতান্ত অবোধ হলে কি এই রকম হয়! যখন রাগল তখন সে রাগ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, কোনও মাত্রা মানল না, এলোমেলো বাতাস পাওয়া শিখা ওঠা আগুনের হলকার মতন তার ক্রোধের হলকা চারপাশে যা পারল তার গায়ে ছোবল দিল, তারপর কখন সব আবার শান্ত হয়ে গেল। আঁচ বা আগুন আছে তাও মনে হবে না। অবোধে এই ভাবে রাগ করে, দপ করে জ্বলে ওঠে, খানিক পরেই আবারই নিভে যায়।
ছেলেমানুষের। রাগ। তার জ্বলতে যতক্ষণ নিবতেও ততক্ষণ। তুষার ভেবেছিল, আদিত্যর শিক্ষা হয়ে গেছে, মানুষটা আহত ক্ষুব্ধ অপমানিত হয়ে আক্রোশে রাগে যা বলার সব বলেছে, এবার নিজেকে সরিয়ে ফেলবে, তুষারকে আর উত্ত্যক্ত করতে আসবে না।
দু তিনটে দিন ওই রকম হয়েছিল। শিশুতীর্থে ওরা সামনাসামনি পড়ে গেছে, প্রায়ই, খাবার ঘরে নিয়মিত মুখোমুখি বসে দু দলকেই খেতে হয়েছে, আদিত্য কোনও রকম অশোভনতা করেনি। বরং তুষার লক্ষ করেছে, তার মনে চাপা রাগও যে আছে আদিত্য তাও প্রকাশ করত না। মুখ বুজে থাকার পাত্র আদিত্য নয়, মুখ বুজে থাকেনি, তবু তার অতিরিক্ত চঞ্চলতাও যেন এ কদিন কোনও অসুখে ভুগছিল, তেমন করে প্রকট হত না।
এরই মধ্যে তুষার কখনও দেখেছে আদিত্য আর মলিনা গল্প করছে গাছতলায় দাঁড়িয়ে, কখনও দেখেছে জ্যোতিবাবু একা কোথাও বসে আছেন, কখনও বা তুষার কান পেতে শুনে নিয়েছে, মলিনা আদিত্যর কাছ থেকে গান শিখে দুপুরে স্নান করতে এসে নিজের ঘরে চুল খুলতে খুলতে সেই গান গাইছে। মলিনার ওই গানের গলায় আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি,–শুনে তুষারের হাসি পেয়েছে। ভেবেছে, যেমন মাস্টার তেমনি ছাত্রী। কিন্তু এও ঠিক, তুষার আদিত্যর গলায় আচমকা যতটুকু শুনেছিল গানটা, তাতে মনে হয়নি আদিত্যর গলার সুর খারাপ। মলিনার গলায় কিন্তু সত্যিই বিশ্রী শুনিয়েছিল, অত্যন্ত বিশ্রী।
এমনি করে কয়েকটা দিন কাটল। শরতের যাওয়া পথে মেঘ আবার দল জুটিয়ে দুটো দিন তুমুল বর্ষা নামাল। শিশুতীর্থ বন্ধ থাকল, নুটুর গাড়ি পাঁচ মাইল পথ এই আসা যাওয়ার ধকল সইতে পারল না। তারপর আবার রোদ উঠল, মেঘের সমস্ত ময়লা যেন কেউ আকাশ থেকে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেছে, তকতকে পরিষ্কার আকাশটা আর নীল, রোদের আভায় অপরূপ উজ্জ্বল।
পরশু মহালয়া। শিশুতীর্থ এখন শিশু-স্বর্গ। ছেলেমেয়েগুলো বই খাতা পত্র আর ছোঁবে না, ঘরেও ঢুকবে না। সমস্ত মাঠ ভরে শুধু তাদের কলরব আর ছোটাছুটি, খেলা আর চাঞ্চল্য।
প্রতিবার মহালয়ার দিন এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে চড়ুইভাতি করতে হয়। এখন একটা আর শীতে আর একটা।
জ্যোতিবাবু আর আশাদি চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করতে মত্ত। সাহেবদাদুর শরীর আজ কদিন সামান্য ভাল যাচ্ছে বলে তিনি ইতির হাত ধরে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের ডেকে নিজেই এক একটা অবাক খেলার নিয়ম শিখিয়ে দিচ্ছেন, ওপাশেই যেন বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় বেশি, প্রফুল্ল নুটুর গাড়ি নিয়ে বাজার হাট করতে ছুটছে শহরে, আর মলিনা আদিত্যর ছায়ায় ছায়ায় ঘুরছে।
তুষারের কিছু অন্য কাজ ছিল। একাজ খানিকটা অফিসের কাজও। মাসখানেকেরও বেশি বন্ধ থাকবে শিশুতীর্থ। এই বন্ধের মধ্যে ক্লাস ঘরগুলোর তদারকির ব্যবস্থা, জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা টাকা পত্র দেওয়া থোওয়া, কয়েকটা ছোটখাটো হিসেব–এই রকম আরও কিছু।
কাগজপত্র নিয়ে কাজ করতে বসে তুষার দেখল, আদিত্য তার দু মাসের পাওয়া সরকারি মাইনের প্রায় সবটাই এখানে জমা রেখে দিয়েছে। টাকাটা তার আজকালের মধ্যে নিয়ে নেওয়া উচিত, মহালয়ার পরও অবশ্য দু-চার দিনের মধ্যে নিতে পারে, না নিলে এই হিসেবপত্রের খাতা বন্ধ হয়ে যাবে, ছুটির মধ্যে কে আবার হাঙ্গামা করবে!
তুষার আরও দেখল, জ্যোতিবাবুর সই করা চিট-এ মলিনা তার মাইনের অতিরিক্ত শ দেড়েক টাকা আগাম নিয়েছে। দেখল, আদিত্যর নামে-আসা একটা চিঠি, তার জবাবও। আদিত্য পুজোর ছুটির আগে চলে যাচ্ছে, তার এখানের কাজ শেষ।
একটানা ঘন্টা দুই কাজ করে তুষার উঠে পড়ল। বেলা হয়েছে। এগারোটা বাজে প্রায়।
সাহেবদাদু বারান্দায় বসে বিশ্রাম করছেন। স্নান করতে যাবেন। ইতি কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুঝি স্নান সারা হয়ে গেছে, মাথার চুল এলো। ঘন বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে ইতি। কেমন বড় বড় লাগছিল দেখতে। তুষার আসতে গিয়ে কী ভেবে সাহেবদাদুর দিকে এগিয়ে গেল।
বারান্দায় উঠতে গিয়ে ইতির সঙ্গে চোখাচুখি। তুষার হাসল। কী রে! তোকে বড্ড বড় দেখাচ্ছে।
ইতি লজ্জায় হাসল। রংটা ভাল, না তুষারদি?
খুব সুন্দর।
তোমার মতন ফরসা রং হলে আরও মানাত।
তুই কি কালো নাকি?
শাড়িটা আমায় আশাদি কিনে দিয়েছে। ইতি বলল, পুজোর জন্যে।
তুষারের খেয়াল হল, ইতির জন্য তাকেও একটা শাড়ি কিনতে হবে। আগে আগে তুষার জামা করে দিত, আজকাল ইতি বেশির ভাগ শাড়ি পরে, শাড়িই কিনতে হবে এবার।