একদিন তোমায় একটা ইংরিজি গান শোনাব। আদিত্য হেসে বলল শিশিরকে লক্ষ করে।
ইংরিজি?
খুব ভাল গান। …আই ওয়াক অ্যালোন…অ্যালোন, মাই ওয়ে ইজ…কথাটা শেষ না করেই আদিত্য তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল, ও হো, আপনাকে বলিনি খবরটা। কাল ঘোড়া জুতে গাড়িটা চালিয়েছি।
কার গাড়ি! শিশির অবাক হয়ে শুধোল।
ওঁদের সাহেবদাদুর। ভাঙা জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল, গাড়িটা ঠিক করলাম ঘোড়া জোগাড় করলাম–তারপর কাল ট্রায়েল দিলাম। …এখনও বেশ রাফ রয়েছে ঘোড়াটা, আরও°ট্রেইন করতে হবে। …এক দিন তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাব। টমটমে চড়ে বেড়ানো একটা প্লেজার। আদিত্য উঠল। শিশিরের হাতে হাত দিয়ে বলল, চলি ভাই। আবার দেখা হবে।
আদিত্য আগে পিছু পিছু তুষার ঘরে ছেড়ে চেলে গেল।
বাইরে এসে আদিত্য বলল, আমার ভয়ে আপনি পালিয়ে গিয়ে বসেছিলেন।
তুষার বারান্দার সিঁড়িতে, আদিত্য শেষ ধাপে নেমে দাঁড়িয়েছে। দেখল না তুষার, চোখ মুখ তুলে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। নিচু গলায় বলতে গিয়ে কথাটা ঠিক মুখে আনতে পারল না।
আদিত্য বাগানে নামল। তার পায়ের চাপে কাঁকরে শব্দ উঠিল। এ ধরনের লুকোচুরি খেলা আমার ভাল লাগে না।
লুকোচুরি! তুষারের স্বর অস্পষ্ট।
আমাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না।
কই, না! তুষার এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়বে জানলে বাড়ি ফিরত না, আরও রাত করত; অনেক রাত।
ন্যাকামি করছেন কেন! আদিত্য ক্ষুব্ধ, সামান্য উত্তেজিত। তুষার বুঝতে পারছিল। আদিত্যর সন্দেহ নেই, তুষার আর পাঁচটা মেয়ের মতন ন্যাকামি করছে। তুষারের দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় আদিত্য বলল, আপনার অত ভয় কীসের! সত্যি কথা বলতে আটকাচ্ছে কেন?
তুষার অসন্তুষ্ট। তার রাগ হচ্ছিল। এই মানুষটা কী ভাবে তাকে? ভদ্রতাকে সে ভয় ভাবে, শিষ্টতাকে ন্যাকামি? তুমি কে, কী তোমার ব্যক্তিত্ব যে তুষার তোমায় ভয় পাবে!
আজ একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া ভাল। রোজ ওর গায়ে পড়া ঘনিষ্ঠতা তুষারের ভাল লাগে না, ভাল লাগে না জোর জবরদস্তি, ইচ্ছাকৃত অবিবেচনা।
মানুষকে বিরক্ত করা, উত্যক্ত করা আপনার স্বভাব। তুষার চাপা রাগে বলল।
আপনাকে আমি উত্যক্ত করি?
করেন কি না করেন আপনি জানেন।
না। আমি জানি, আপনাকে আমার ভাল লাগে।
রাগে তুষারের কপালের শিরা টাটিয়ে উঠল। কেমন করে কথা বলছে ও? তুষার কি তার…
আমাকে, আপনি সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। আদিত্য আবার বলল। কোনও সংকোচ নেই, স্বরে একটু সুরও নেই।
কী লাগে না লাগে আমার শুনে লাভ নই। আপনি যদি ঠিক মতন কথা বলতে না পারেন কথা বলবেন না। তুষারের গলায় যেন কেউ শান দিয়ে মরচে তুলে ক্রমশ ধার ফুটিয়ে আনছে।
আপনি অত অসহিষ্ণু কেন?
সহিষ্ণু হবার কোনও দরকার নেই আমার।
তা হলে এবার স্পষ্ট করেই বললেন–আদিত্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুষারের দিকে তাকাল। ইউ হেট মি…ঘেন্না করেন!
তুষার নীরব। তার ইচ্ছে হচ্ছিল, সোজা ঘরে চলে যায়। যাচ্ছিল না, যদি এখানে আজ একটা নিষ্পত্তি ঘটে যায়–যাক। প্রত্যহ এই পীড়ন তার ভাল লাগে না।
সামান্য অপেক্ষা করে আদিত্য দু পা এগিয়ে এল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে তার একটা পা রাখল। আমাকে আপনি কী ভাবেন? বাঁদর না হনুমান?
তুষার নীরব। কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না।
আপনাকে উত্ত্যক্ত করা আমার চাকরি নয়। …ভাল লাগত বলে আসতাম। দু মুহূর্ত থেকে আদিত্য হাত দুলিয়ে কেমন এমন একটা ভঙ্গি করল, বলল, ন্যাকাবোকা ছেলেদের মতন আমি মেয়েদের কাছে আসতে শিখিনি। …দূরে দূরে থাকলে, আপনার ছায়ার দিকে তাকিয়ে হু হা করলে আপনি ভাবতেন আহা, বড় ভালবাসে আমায় ও। আদিত্য পাগলের মতন বলছিল, বলার সময় ওর গলার স্বর প্রচণ্ড লাগছিল এবং মনে হচ্ছিল সে এক একটা শব্দকে বিকৃত করে ঠাট্টা করে আরও হাস্যকর করে তুলছে। আমি ওই ধরনের সাবুবার্লি খাওয়া প্রেম করতে দেখেছি। আই হেট ইট…। আমার কিছু আসে যায় না। হ্যাঁ, আপনার মতন আমারও কিছু যায় আসে না। …আপনি ভাবছেন, আমায় খুব ঠোক্কর দিলেন! খুব শিক্ষা দিলেন আমায়! আমি গ্রাহ্য করি না। পরোয়া করি না। বুঝলেন তুষারদিদিমণি, আমার চরিত্র আলাদা। ভালবাসা না পেলে আমি মরে যাই না৷বলতে বলতে আদিত্য সিঁড়ির ওপর তুষারের গায়ের কাছে এসে পড়ল। এবং পরক্ষণেই হাত ধরে ফেলল, তুষার বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে, আদিত্য বলল, আমার ভালবাসা ওয়েল ড্রেসড নয়, সিভিলাইজড নয়, কিন্তু সেটা বাঁদর হনুমানের মতনও নয়। আপনি যেমন দেখলে আহ্লাদিত হতেন–বিহ্বল হয়ে পড়তেন তেমন করে আসতে পারিনি। …কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমার ভাল লাগে।
তুষার জোর করে হাত টেনে নিল। সর্বাঙ্গ তার জ্বালা করছে। রাগ ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় তুষারের মনে হচ্ছিল, লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে, চলে যান এখান থেকে। অভদ্র ইতর কোথাকার!
আদিত্যর কী হয়েছিল কে জানে, তুষার হাত টেনে নিলে সে হাসল, হো হো করে হাসতে লাগল, অপ্রকৃতিস্থের মতন। হাসি থামলে দেখল তুষার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ বলল বাড়ির ভেতর চিরকাল থাকতে পারবেন না দিদিমণি, একদিন বাইরে আসতে হবে। তখন দেখবেন আমি নেই।
তুষার কথাগুলো শুনল কি শুনল না–বোঝা গেল না। ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করল।