দেরি হওয়ার কথাটা বলেছিল এই জন্যে যে, যদি আদিত্য খোঁজ নেয়, জানতে পারবে তুষারের ফেরার দেরি আছে, অপেক্ষা করবে না। অথচ তুষারের সমস্ত অভিসন্ধি আদিত্য ব্যর্থ করল।
এই বা কী রকম? আলাপ পরিচয় নেই শিশিরের সঙ্গে, তবু একটা বাইরের লোক সদর থেকে অন্দরে ঢুকে দিব্যি দাবা খেলছে বসে বসে। কোনও গা নেই, গ্রাহ্য নেই, সঙ্কোচ নেই। শিশিরই বা ওকে কেন ঘরে আসতে দিল!
তুষার একবার ভাবল, যেমন নিঃশব্দে সে এসেছে তেমনি নিঃশব্দে সে চলে যায়। আবার বাইরে, বাড়ি ছেড়ে কাছাকাছি কারও বাড়ি গিয়ে বসে থাকে। যদি রাত দশটা বাজে বাজুক, এগারোটা বেজে যায় তাতেও ক্ষতি নেই, আদিত্যকে দেখা না দিয়ে সে ফিরিয়ে দেবে। কতক্ষণ বসে থাকবে আদিত্য, কত সময় সে অপেক্ষা করতে পারবে।
এখন কটা? আটটা বেজে গেছে বোধ হয়। তুষারের মনে হল, সে নিজেই বোকামি করেছে। তার আরও বেশিক্ষণ বাইরে থাকা উচিত ছিল। অথচ, বাইরে কেমন যেন সময় দীর্ঘ ও গত মনে হল, মনে হল রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ক্রমাগত তাকে অন্যমনস্ক করতে লাগল, সে ফিরে এল।
তুষার দুপা এগিয়ে এল। পালিয়ে গিয়ে লাভ নেই। আদিত্য, বলা যায় না সারারাতই বসে থাকতে পারে।
গলায় শব্দ করল তুষার। শিশির নৌকো চালতে ব্যস্ত, চোখ তুলল। দিদি। বলল ওই যা, আবার চাল দিতে চোখ নামাল।
আদিত্য যেমন বসেছিল তেমনি, মুখ ঘাড় ফেরাল না। তুষার অবাক হল।
তুষারের আবির্ভাব ওদের দুজনকে বিচলিত বা অব্যবস্থচিত্ত করতে পেরেছে এমন লক্ষ্মণ কোথাও দেখা গেল না। পায়ের মাপ আরও একটু বাড়াল তুষার, জানলার পাশে চায়ের কাপ পড়ে আছে, বোঝ দায়-দাবা–দাবা খেলার শুরুতে বা মধ্যে শিশির অতিথি আপ্যায়ন করেছে। তবে কি শিশিরই অতিথি বৎসল হয়ে আদিত্যকে ডাকিয়ে এনে ঘরে বসিয়েছে? শিশিরের ওপর রাগ হচ্ছিল তুষারের। সে যাকে এড়িয়ে যেতে চায় শিশির তাকে আদর করে ঘরে ঢোকায়। বাঁদর কোথাকার! কী বিশ্রী কাণ্ডটা বাঁধাল শিশির!
আদিত্য বিড় বিড় করে কী বলল আপন মনে, একটা চাল দিল, দিয়ে মাথা চুলকোল। এবং পরের চাল ভাববার জন্যেই সিগারেট ধরাল।
রাগ হচ্ছিল তুষারের। কেন হচ্ছিল সে জানে না। দাবা খেলার জন্যে, নাকি তার দিকে কারও ক্ষেপ নেই দেখে! আদিত্য কি এখনও খেয়াল করতে পারছে না, তুষার ঘরে এসেছে?
ইচ্ছে করেই, যেন আদিত্যকে তার দাবার নেশা থেকে অন্যমনস্ক করে দেবার জন্যেই তুষার বিছানার মাথার দিকে–শিশিরের পাশে এগিয়ে গেল। কখন এলেন?
আদিত্য ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তুষারকে। এই যে! এসেছেন তা হলে!
তুষার এমন ভাবে তাকাল, যার অর্থ সে বলতে চাইছে, মানে–তা হলে এসেছেন মানে কী?
শিশির আদিত্যর রাজা বেঁধে ফেলেছে। বলল, এবার সামলান।
আদিত্য দাবার ছকের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড। বলল, হেরে গেলাম, ভাই। বলে হাত বাড়িয়ে শিশিরের হাতে চাপ দিল।
হাসল শিশির। বলল, আপনার দুটো চাল আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সামলেছি।
আমি সেই কবে খেলেছি, চাল-ফাল ভুলে গেছি। তা ছাড়া ওই কনসেনট্রেসন–ওটা আর হয় না।
তা হলেও পাকা খেলোয়াড়ের মতন খেলেছেন।
আদিত্য অট্টহাস্যে হাসল।
শিশির দিদিকে বসতে দিচ্ছে এমন ভাব করে সামান্য সরে গেল। তুষার বসল না।
আদিত্য এবার তুষারকে ভাল করে দেখল। তারপর হাতঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে ছটায় এসেছি, এখন আটটা কুড়ি৷ খুব লোক আপনি।
তুষার চোখে চোখে তাকাল আদিত্যর, লহমার জন্যে চোখ ফিরিয়ে শিশিরের দিকে রাখল। এক জায়গায় যেতে হল, দরকারি কাজ ছিল একটা। …বলে তুষার সামান্য থামল, শিশিরের সামনে সমস্ত ব্যাপারটাকে সে শালীন স্বাভাবিক করতে চাইল, অনেকক্ষণ বসে আছেন তা হলে–অপরাধ মার্জনা করুন গোছের ফিকে একটু হাসি টানল মুখে। সময় ভালই কাটছিল দেখলাম!
ভালই। আদিত্য জবাব দিল। আমায় কখনও বড় একটা জলে পড়তে হয় না। কথা শেষ করে আদিত্য চোখের তারা এবং পাতায় যে ভাব দেখাল তাতে মনে হল, আদিত্য যেন বলছে, আমি এসব গ্রাহ্য করি না।
হয়তো আদিত্য তার ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেছে, তুষার ভাবল। ভাবল, যদি বুঝে থাকে তবে বসে ছিল কেন? কেন ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে না? অপমান বোধ করছে না?
আপনার ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। আদিত্য বলল, শিশিরের দিকে সস্নেহের চোখে তাকাল, আমায় গান গাইতে বলছিল।
গান! অস্ফুটে বলল তুষার, প্রথমে আদিত্য পরে শিশিরের দিকে তাকাল।
সেই যে– শিশির হেসে দিদিকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করল, আমি পথ ভোলা এক পথিক… আমি বলছিলাম, আপনার গান শুনেছি সেদিন, আপনাকে দেখিনি; আজ দেখলাম। বললাম একটা গান করুন, গলা ছেড়ে; গাইলেন না। শিশির হাসছিল।
তুষার এই হাসি, এই জলের মতো সাধাসিধে অন্তরঙ্গতা পছন্দ করছিল না। শিশিরের কাণ্ডজ্ঞান বড় কম। আদিত্যর কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই। কী ভেবেছে লোকটা? শিশুতীর্থ থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অন্দরমহল, ও কি ভেবেছে পা বাড়ালেই সব দরজা খুলে যাবে! না। দরজা খুলবে না।
মনে মনে ছটফট করলেও কিছু বলতে পারছিল না তুষার। শিশিরের কাছে দৃষ্টিকটু হয় এমন কিছু করা, শ্রুতিকটু হয়–এমন কিছু বলা যায় না। বিছানার মাথার দিকে অকারণে ঝুঁকে চাদরটা ঠিক করে হাতে হাতে ঝেড়ে দিল।