তুষার আবার অস্বস্তি বোধ করল! হ্যাঁ, আছে। কিন্তু তুষার কি তাই বলবে না কি! পাগল! কেউ কি বলে তা! কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্যে তুষার বলল, ওসব কথা থাক। এখানে–
বলা যায় না বলছেন? বেশ তা হলে বাড়িতে যাব।
বাড়ি! তুষার অস্ফুট গলায় বলে ফেলল।
বারণ করছেন যেতে?
না, না। সে কী…! তুষার তীর ছাত্রীদের মতন বিপর্যস্ত বোধ করে ঢোঁক গিলল।
তা হলে কাল যাব। …আদিত্যর গলা সরল, আজ একবার ঘোড়াটাকে গাড়িতে জুতে ট্রায়াল দিতে হবে। সাংঘাতিক বদমাস ঘোড়া! বাট, আই উইল মেক দ্যাট অ্যানিমাল বিহেভ প্রপারলি।
বলতে বলতে আদিত্য বোধ হয় ঘোড়ার চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে জানলা থেকে সরে গেল। চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে।
জানলাটা এতক্ষণ আদিত্যর শরীরে আড়াল হয়ে ছিল। ও চলে গেলে আবার মাঠ ঘাস গাছ দেখা গেল। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র চোখে পড়ল। চোখে পড়ল একটা হরিয়াল পাখিও।
তুষার জানলা দিয়ে তাকিয়ে অনুভব করল, সে অনেকক্ষণ যেন নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল। বুক ভারী লাগছে। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেলল।
.
১২.
বাড়ির বারান্দার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠল তুষার। আতাগাছটার পাশে সাইকেল। হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে তুষার আর পা বাড়াতে পারল না। আদিত্য তা হলে এখনও অপেক্ষা করছে।
ভয় হল তুষারের। বাড়ির বাগানটা ছোট, গাছপালা প্রচুর নয়; চারদিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আদিত্যকে খোঁজার চেষ্টা করল। তার ভয় হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল, কোনও গাছপালার আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে আদিত্য তার সামনে দাঁড়াবে, বলবে–এই রকম অভদ্রতা কেন, আমায় আসতে বলে বাড়ি থেকে পালানো?
বাগানে কোথাও নেই আদিত্য, বারান্দাতেও নেই। তবে কোথায় গেল? চলে গেছে! চলে যাবে যদি তবে সাইকেল পড়ে থাকবে কেন? তা হলে কি তুষারকে না পেয়ে সাইকেল রেখে অন্য কোথাও ঘুরে আসতে গেছে? বোধ হয় তাই। আবার আসবে আদিত্য।
সামান্য সময় লেবুগাছের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে তুষার পা পা করে বারান্দার দিকে এগিয়ে চলল। আদিত্য আসবে জেনেও সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তুষার আশা করেছিল, বাড়ি এসে তাকে না পেয়ে আদিত্য ফিরে যাবে। ক্ষুণ্ণ হবে, রাগ করবে। তা হোক ক্ষুণ্ণ, তুষারের কিছু আসে যায় না। পরে দেখা হলে বলবে, আমায় একটা জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল, কিছু মনে করবেন না।
প্রকৃতপক্ষে তুষার চায়নি, আদিত্য তার বাড়ি এসে আবার জ্বালাতন করুক। ওর উৎপাত সহ্য করা উচিত না; প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষকে একটু প্রশ্রয় দিলেই তারা মাথায় ওঠে। বাস্তবিক, আদিত্যকে ছেলেমানুষ বা পাগল ভেবে নিতান্ত ভদ্রতা করে যেটুকু সহানুভূতি দেখিয়েছে তুষার তার পরিণাম এখন বিশ্রী হয়ে উঠেছে! সামলাতে পারছে না তুষার। আদিত্য যেন পেয়ে বসেছে।
ইচ্ছে করে, জোর করে, আদিত্যকে দূরে সরাবার মতন কারণ তৈরি করার অন্যতম উপায় হিসাবে আজ তুষার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে জানত, আসব যখন বলেছে তখন আদিত্য আসবেই আর এলে সহজে মুক্তি দেবে না, লক্ষটা কথা বলবে জ্ঞানহীনের মতন। এমন অদ্ভুত কোনও অনুরোধ করে বসবে যা করা অশোভন, অযথা অনর্থক তুষারকে ক্রমাগত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। …
যারা অন্যের সহ্য অসহ্য বোঝে না বুঝতে চায় না, যারা জানে না অন্যেরও ভালমন্দ লাগা আছে, ছোঁয়া পেলে আঠার মতন জড়িয়ে থাকতে চায়, ফুটে যাওয়া কাঁটার মতন যন্ত্রণা দেয় তাদের কাছ থেকে রেহাই পেতে হলে এ ছাড়া আর কী পথ আছে ওই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া, দূরে দূরে সরে থাকা বই?
কিন্তু, মানুষটা গেল কোথায়? তুষার বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তাকাল আবার, ভাল করে দেখল।
এমন তো নয়, তুষার ভাবল, আদিত্য চলেই গেছে, শুধু তুষারকে বিব্রত করতে ভয় দেখাতে সাইকেলটা রেখে গেছে? হতে পারে; কিছুই আশ্চর্য নয়। বরং, তুষারের মনে হল, বরং আদিত্যর যা স্বভাব তাতে এই রকম বিশ্রী কিছু করাই তাকে মানায়। সে তোমায় উদ্বেগে রাখবে, দুশ্চিন্তা যাতে জিইয়ে থাকে তার চেষ্টা করবে, তোমায় ভীত ব্যস্ত পীডিত করবে, ওতেই ওর আনন্দ।
কয়েক দিন আগে সেই রাত্রে আসব বলে শাসিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে তুষার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরের মধ্যে পা বাড়াল।
ঘর থেকে বারান্দা। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। গঙ্গা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। বারান্দার একপাশে মিটমিটে বাতি। অন্ধকারে ডুবোনো দাওয়ায় দড়ির ওপর তুষারের ভিজে শাড়ি বাতাসে দুলছে। তুষার দু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল, উঁচু মুখে আকাশ দেখল, তারার প্রশ্ন চিহ্নটা একেবারে চোখের সামনা সামনি।
গঙ্গাকে ডাকবে ভেবেছিল তুষার। না ডেকে শিশিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। শিশির বলতে পারবে, ওই মানুষটা কখন এসে ছিল? বাইরে থেকে চিৎকার করে কিছু বলে গেছে কিনা!
শিশিরের ঘরে পা দিয়ে তুষার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। না এগুতে না পিছিয়ে আসতে পারল। চোখের পাতা স্থির, অপরিসীম এক বিস্ময় তাকে বিমূঢ় করেছে। শিশিরের বিছানার ওপর দাবার ছক বিছানো, লণ্ঠনটা জানলার ওপর, দুজনে, গালে হাত দিয়ে দাবার চাল ভাবছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে। আদিত্যর পিঠ দরজার দিকে।
তুষার এতটা প্রত্যাশা করেনি, কল্পনাও করেনি। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শিশিরকে তার পালাবার কারণ পর্যন্ত না, বলেছিল আমি সুষমা বউদিদের বাড়ি যাচ্ছি রে, দরকার আছে! ফিরতে দেরি হবে।