তুষার দু মুহূর্ত দেখল আদিত্যকে, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, রাগ! কীসের রাগ?
কী করে জানব। তবে আপনার মুখ দেখে মনে হল না আমার ওপর যথেষ্ট অনুরাগ দেখিয়ে উঠে এলেন।
তুষারের কানে শব্দটা ভাল শোনাল না। মনের মধ্যে যেন কাঁকর পড়েছে–অনুরাগ শব্দটা সেই ভাবে অস্বস্তি জাগাল। বিরক্তস্বরে ও বলল, আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
বাজে কথা বলছেন কেন!
বাজে কথা!
আমার ওপর আপনার এত বিতৃষ্ণা কেন বলুন তো তুষার দিদিমণি–আদিত্য হাস্যকর গলা করে বলল, যেন সত্যিই সে একটা কথা সরাসরি জানতে চাইছে।
তুষার জানলা দিয়ে তাকাল। আদিত্য প্রায় সবটুকু জানলাই জুড়ে নিয়েছে। ওপাশের মাঠ বা গাছ আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না জ্যোতিবাবুর ঘরের বাইরের অংশ। কে কোথায় রয়েছে এখন, কে দেখছে, যদি তুষারের ঘরের সামনে আদিত্যকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী ভাববে ইত্যাদি চিন্তায় তুষার অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হল।
বিতৃষ্ণা সতৃষ্ণার কথা নয়–তুষার চোখ নামিয়ে বলল, এখন বিশ্রামের সময়, আমি বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না দয়া করে…, এটা–তুষার কথা শেষ করতে পারল না।
আদিত্য গ্রাহ্য করল না। বরং আরও যেন দৃষ্টিকটু কাণ্ড করল, জানলার কাণা ধরে দাঁড়াল। সদা সত্য কথা বলিবে। কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিবে না। …আপনি সাদামাটা সত্যি কথাটা বলে ফেলুন না, ঝঞ্ঝাট চুকে যায়।
কী বিরক্তিকর! মানুষটা কি কানে তুলো গুঁজে গায়ে গণ্ডারের চামড়া দিয়ে থাকে। কেন তুষারকে ও বার বার এমন করে অপ্রসন্ন বিরক্ত করে তুলতে চায়। ভাল লাগে না তুষারের সহ্য হয় না। বিশ্রী লাগে তুষারের, গায়ে যেন জ্বালা করে, মনে ঘৃণা আসে। তুষারকে কি ও তার পরিহাসের পাত্রী পেয়েছে?
আপনি এখান থেকে যান। তুষার শক্ত গলায় বলল। এটা গল্পগাছা করার জায়গা নয়।
কেউ দেখবে এই ভয় বোধ হয় আপনার!
দেখতে পারে।
দেখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
আমি পছন্দ করি না।
আমায় যে কেন আপনার এত অপছন্দ আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমি আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। …হোয়াই শুড ইউ হেট মি? হোয়াই? অ্যাম আই এ লোফার? …কী, ব্যাপারটা কী? সরাসরি মন খুলে বলে দিন।
আদিত্য এমন ভাবে জানলার মধ্যে ঝুঁকে পড়ল যে, তুষারের মনে হল ও বোধ হয় গলে আসবে ফোকর দিয়ে। আসা কিছু অসম্ভব নয়, জানলাটায় গরাদ নেই, দু পাট খড়খড়ি শুধু। আর আদিত্যর পক্ষে সব সম্ভব। তুষার আরও বুঝল আদিত্য সত্যিই আহত হয়েছে, রেগেছে।
কী বলবে ভেবে পেল না তুষার। মাথায় কোনও আপাতবুদ্ধি আসছিল না। সঙ্কুচিত আড়ষ্ট ভাব নিয়ে তুষার শরীরটাকে চেয়ারের পিছু দিকে টেনে নিল। বলল, ছেলেমানুষি করবেন না। …আমায় এবার উঠতে হবে।
উঠেই দেখুন, একটা কেলেঙ্কারি করব।
মানে?
চেঁচাব।
চেঁচাবেন–
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সুর করে কবিতা আওড়াব। আপনার ঘরের সব ছেলেমেয়েকে যদি বাইরে বের করে আনতে না পারি তো কি! জাস্ট লাইক দি পাইপপাইপার অফ হ্যাঁমেলিন। আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাব, আপনার ছেলেমেয়েরা নেংটি ইঁদুরের মতন নাচতে নাচতে আমার সঙ্গে যাবে। …দেখতে চান? আমি পারি।
আদিত্য এমন ভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সে তুষারের সঙ্গে এই নিয়ে একটা বাজি ধরতে চাইছে। তাকে খুব নিঃসন্দেহ দেখাচ্ছিল।
না, থাক। তুষার বিশ্বাস করল না এই পাগলকে। হয়তো পারবে না, হয়তো পারবে। পারুক না পারুক একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার ঘটবে যে তাতে তুষার নিঃসন্দেহ।
আদিত্য বিজয়ীর মতো হাসল। বলল, তবে বসুন। এমন কিছু দেরি হয়ে যায় নি। এখন মাত্র দেড়টা। হাতের ঘড়ি দেখল আদিত্য, দেখাল।
তুষার ভিজে চুলের গোছাটা পিঠে সরিয়ে দিল। কী বিপদেই পড়া গেল! এ মানুষ কেমন, তাড়ালে যায় না, বিরক্তি দেখালে গ্রাহ্য করে না, অপমান করলে মাখে না। আচ্ছা, ওকে কি সত্যি রূঢ়ভাবে অপমান করে দেখবে একবার তুষার, কী হয়! ও গায়ে মাখে কি মাখে না। তুষার চোখ তুলল, দেখল আদিত্যকে, কিছু বলতে পারল না। বলতে ইচ্ছে করল না।
দেখুন দিদিমণি আদিত্য পরিহাস করে বলল, আমি স্ট্রেট ব্যাপারটা পছন্দ করি। যা করব পরিষ্কার। লুকোচুরি, মুখ আড়াল করে কথা বলা, আই হেট ইট। …সরাসরি বলে ফেলুন তো, আপনার চক্ষুশূল হবার মতন কারণটা কী ঘটিয়েছি?
তুষার এই বিপদ থেকে আপাতত মুক্তি পেতে চায়। চায় বলেই কথা বাড়াবে না, মানুষটাকে শাসাবে, বরং কেমন যেন আপোস করার ভাবই ভাল দেখাবে। তুষার অপ্রসন্নতা মুছে নেবার চেষ্টা করে বলল, কী যা তা বলছেন আপনি! কীসের চক্ষুশূল!
তবে?
কী তবে!
আমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার কেন?
আমি কোনও দুর্ব্যব্যহার করিনি। কেনই বা করব! ..এখানে আপনিও যা আমিও তাই।
পাগল। আদিত্য ঘোরতর প্রতিবাদের ভান করল, আমি আউটসাইডার। আপনি ভেতরের লোক। আমার কাজ ভাঙার, লণ্ডভণ্ড করার আপনার কাজ…কী বলে যেন…আপনার কাজ রক্ষণের, লালনের পালনের-আদিত্য টেনে টেনে বলল, পরিহাসের গলায়।
আপনি কি নিজেকে কালাপাহাড় ভেবে খুশি হন। তুষারের গলার স্বর তার অজান্তে নরম কোমল ও সরস হয়ে এসেছিল।
না। আমি নিজেকে কালাপাহাড় ভাবতে চাই না। লোকে আমায় ভেবে নেয়।
অন্যায় করে?
বোধ হয়। আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল। চুপ করে থাকল দু মুহূর্ত, আবার বলল, আমার চরিত্রে অনেক দোষ আছে, না কি বলুন?