চল্লিশ টাকা জেতা কিছু নয়… আদিত্য ও-তরফ থেকে বলল, যার লাক ফেবার করে সে চার হাজারও একদিনে জিততে পারে চোখের পলকে। ইট ইজ এ কোশ্চেন অফ লাক!
জুয়া খেলা ভাল না–প্রফুল্ল মিনমিনে গলায় বলল, মানুষে শুনেছি হারে বেশি, জেতে কম।
আদিত্য হেসে উঠল। উচ্চস্বর সেই হাসির কোনও মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না তুষার। খাবার ঘরটা কি জুয়ার গল্পের আড্ডা হয়ে উঠল! বিরক্ত হয়ে তুষার হাত গুটিয়ে নিল। আশাদিও অসন্তুষ্ট।
মলিনাকেই যা উৎসাহিত দেখা গেল, এই সব গল্প যেন তার খুব ভালই লাগছে।
হাসি থামলে আদিত্য প্রফুল্লকে উপলক্ষ করে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, আপনি মশাই শিশুশিক্ষার বই-টই লিখুন, বেণীর গল্প গোপালের গল্প-টল্প, বিদ্যাসাগর মশাই মার খেয়ে যাবেন। …যা বললেন একটা কথা, জুয়া খেলা ভাল না, মানুষ হারে বেশি–জেতে কম! …আরে মশাই, সব খেলাতেই হারের আশংকা বেশি, আপনার কথাটাই ভেবে দেখুন না–উইন করছেন নাকি, বেধড়ক হেরে যাচ্ছেন। তবু তো পড়ে আছেন মাটি কামড়ে। জীবনে জেতাটাও ভাগ্য! লেট আস হোপ ফর দি বেস্ট–বলতে বলতে আদিত্য চোখ তুলে তুষারের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল।
তুষার মাথা তুলতেই সেই চোখ দেখতে পেল। তার অস্বস্তি হল, ঘৃণা হল। কী করে একটা লোক বার বার এভাবে মেয়েদের দিকে তাকায়! তুষার এবার স্পষ্ট গলায় আশাদিকে বলল, আমি উঠছি, আশাদি। অপেক্ষা করল না আর তুষার, এঁটো কুড়িয়ে নিয়ে উঠল পড়ল। জ্যোতিবাবু যে তার দিকে তাকাল, তুষার দাঁড়িয়ে ওঠার পর তা লক্ষ করল।
.
দুপুরের আলস্য গভীর করে জড়িয়ে ধরেছে তুষারকে। নিজের ক্লাস-ঘরের কুঠরিতে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সে শুয়ে আছে। সামনে ফালি জানলা। শরতকালের এই দুপুর এখানে কী জারকে যেন জরে যাচ্ছে। সামনের মাঠটুকুতে ছায়ার কাপড় যেন শুকোতে দেওয়া হয়েছে, এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ার মধ্যে রোদ, দুপুরের রোদ বলেই প্রখর, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আর সম্মিলিত পক্ষীকুলের বিচিত্র শব্দ কখনওঁ নিকটে কখনও দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে। পড়ার ঘরে ছেলেমেয়েগুলো খেলছে হয়তো, খেলা শেষ হলে আজ পাঁচটা ধাঁধাঁ করবে। ধাঁধাঁগুলো তুষার ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়ে এসেছে। এই ধাঁধার মধ্যে একটা বানান সংক্রান্ত, একটা মহাভারতের, একটা ভূগোলের, আর বাকি দুটো অঙ্কের। ছেলেমেয়েরা খুব ভালবাসে এই ধাঁধা। তুষার জানে ধাঁধার খেলা নিয়ে এক দেড় ঘণ্টা ওরা অনায়াসে কাটিয়ে দেবে। গোলমাল করবে না, বাইরে পালিয়ে যাবে না।
ক্যাম্বিসের চেয়ারে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তুষার চোখের পাতা ক্রমে ছোট করে আনছিল, যেন কপালের কোথাও আলস্যজাত ঘুমের কাজল আছে, চোখের পাতায় ছুঁইয়ে নিতে পারলেই চোখ জুড়ে যাবে। ভাল লাগছিল ওর, শরীরের প্রতি অণু এই মধ্যদিনের পুঞ্জিত বিশ্রামের মধ্যে শিথিল হয়ে আসছিল।
তুষার ছুটির কথা ভাবছিল। পুজোর ছুটি যেন এখন থেকেই নেশার মতন টানছে। যত তাড়াতাড়ি ছুটি হয়, ততই ভাল। তুষার জানে না, সেই ছুটি কেন তার এত কাম্য। তবু মনে হচ্ছে ছুটিটায় সে বিশ্রাম নেবে, এই প্রাত্যহিক কর্ম থেকে বিরতি, একটানা কাজ থেকে খানিক ছুটি।
নিজেকে তুষার বাস্তবিক আজ কদিন ক্লান্ত অনুভব করছে। তার এমন চিন্তা–এই ক্লান্তি অনুভব আগে কখনও আসেনি। শরীর হয়তো ক্লান্ত লেগেছে, সে ক্লান্তি পরিশ্রমের, আসা যাওয়ার, দায় দায়িত্ব পালনের। আজকাল যে ক্লান্তি অনুভব করছে তুষার–তা শরীরের, ঠিক শরীরজাত নয়, পরিশ্রমের জন্যেও নয়। মনের কোথাও যেন একটা ভাল না লাগার ভাব। উদাস ও অবসন্ন হওয়ার শূন্যতা বোধ করছে। কেন? এরকম কেন লাগছে তুষারের? তার শরীর কি ভাল যাচ্ছে না!
তন্দ্রায় চোখ জড়িয়ে তুষার ঘুমিয়ে পড়ছিল। আচমকা গলা শুনে চোখ খুলল তুষার। তার জড়তার মধ্যে আদিত্যকে দেখল। দেখেও যেন মনে করতে পারল না, ওই লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ঘুমের চোখে তাকাল, আবার পাতা বুজল।
বাঃ, দিব্যি ঘুমোচ্চন তো! আদিত্য বলল।
তুষার ঘুমের বোজা চোখে ঠোঁটে যেন হাসল, ফিক করে। সে দেখছিল না।
মেয়েরা দুপুর বেলায় খানিক গা গড়িয়ে নেয় তা হলে–সে যেই হোন। আবার বলল আদিত্য।
চোখ মেলল তুষার। ফালি জানলার ওপাশে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাতের আঙুলে চোখের পাতা বুলিয়ে তুষার আবার দেখল। আদিত্য। তা হলে তন্দ্রায় বা ঘুমের জড়তায় নয়, সত্যিই আদিত্যকে সামনে দেখছে তুষার। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের কাপড় ঠিক করে ক্যাম্বিসের চেয়ারের ওপর সোজা হয়ে, পিঠ উঁচু করে নিয়ে বসল তুষার। পায়ের দিকের কাপড় গুছিয়ে টেনে নিল। চোখের দৃষ্টিতে বিরক্তি ফুটল।
আপনি! তুষার গলা তুলতে পারল না।
দেখতে এলাম আপনাকে। আদিত্য বলল, মুখে সেই হাসি, তুষার যে-হাসি অপছন্দ করে।
কথাটা কানে কটু শোনাল তুষারের। অভদ্র!
আপনি কী মনে করেন? তুষার খুব অপ্রসন্ন হলেও রাগ যথাসম্ভব সংযত করে বলল। বলে তিরস্কারের চোখে চেয়ে থাকল।
আদিত্য জানলার কাছে আরও সরে এল দু পা-খাঁচায় বন্দি কোনও প্রাণীকে কৌতূহলে সকৌতুকে দেখছে–এমন চোখ করে দেখল সামান্য সময়। বলল, আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আপনি বড় অদ্ভুত পদার্থ!
অদ্ভুত!
রাগ করে খাওয়ার ঘর থেকে উঠে এলেন কেন? আদিত্য স্পষ্ট গলায় জানতে চায়।