খুবই আচমকা তুষার কেমন বিরক্তি অনুভব করল, রাগ হয়তো। বলল, এতে জ্যোতিবাবুর দোষ কোথায়?
দোষ দিচ্ছি না আমি, বলছি। জ্যোতিবাবু মলিনাকে প্রশ্রয় দেন যথেষ্ট। নয়তো এরকম সাহস মলিনার হত না।
মলিনার নিজেরই বোঝা উচিত। তুষার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল।
কে বুঝবে! কোনও জ্ঞান-গম্যি আছে তার। আশাদি এবার রাগের গলায় বলল, এখানে ওকে দিয়ে কাজ চলে না। সে স্বভাব মন ওর নয়। জ্যোতিবাবু ভাবেন, ওকে তৈরি করে নেবেন। তৈরি হবার মতন মেয়ে ও নয়। সে যোগ্যতা মলিনার নেই। আশাদিও উঠে পড়ল।
চল খেয়ে আসি। বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিতে দিতে নিচু গলায় আশাদি বলল, আর ওই এক এসে জুড়ে বসেছে। যাবার নাম করে না। …তুই জানিস তুষার, একটা ঘোড়া কোথা থেকে এনে সাহেবদাদুর পুরনো গাড়িটায় জুড়ে গাড়ি হাঁকাবার চেষ্টা করছে। কাল ওই করতে গিয়ে মরত। যত বিদঘুঁটে কাণ্ড!
তুষার নীরব। আশাদির বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মলিনার ঘরের দিকে তাকাল একবার, দরজা বন্ধ। মলিনা সকালেই স্নান করে নেয়, দুপুরে সে বড় একটা ঘরে আসে না। প্রয়োজন হয় না তার।
বাড়ির নীচে দু পাঁচ পা এগিয়ে একটা গাছ। বেশ বড়, লম্বা লম্বা পাতা। ওরা কেউ নাম জানে না গাছটার। বুনো কোনও বৃক্ষ। …ঘুঘুটা তখনও ডাকছিল। তুষার খাবার ঘরের দিকে তাকাল। ছেলেমেয়েরা খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে–ঝি এঁটো ফেলছে। এক খণ্ড দুধের মতন সাদা মেঘ চোখে পড়ল তুষারের। তার এখন আর কিছু ভাল লাগছিল না। অল্প আগে এই শরতের স্পর্শ মনকে হালকা আলস্য লোভী করেছিল। এখন সব বিরস লাগছে। ভাল লাগছে না। রোদের তাত মুখে লাগার মতন গাল কপাল তপ্ত লাগছে। তুষার খাবার ঘরের দিকে হেঁটে চলল।
.
খাবার ঘরে একপাশে মেয়েরা–আশাদি তুষার মলিনা; অন্য দিকে জ্যোতিবাবু প্রফুল্ল আর আদিত্য। মাটিতে বসে খেতে হয়। হাট থেকে কিনে আনা শালপাতার অভাব পড়ে না, পড়ে এনামেলের থালা বাটির। বাচ্চাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শালপাতা পেতে দিলে তারা খুব খুশি হয়। তুষারদের অবশ্য কাঁসার থালা কিন্তু বাটি গ্লাস এনামেলের।
ওরা পুরুষরা একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে বসে খাচ্ছিল। খাবার ঘরের জানলাগুলো হাট করে খোলা, ডালিম গাছটা চোখে পড়ে। সিমেন্ট করা মেঝেতে রোদের আভা আর নেই, ছায়া ছড়িয়ে আছে। ঘরটা নিরিবিলি; একটা কালো ভ্রমর এসে সমস্ত ঘরে গুঞ্জন তুলেছে; কখনও কখনও বাইরে থেকে দাসদাসীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
খাবার সময় সচরাচর মেয়েদের তরফে বড় একটা কথা হয় না; বা হলেও কোন খাবারটা কেমন হয়েছে তার জন্যে আশাদিকে হয়তো পুরুষপক্ষ থেকে কিছু বলা হয়। পুরুষদের দিকে মোটামুটি একটা কথাবার্তা থেকে যায়। মেয়েরা হয়তো খেতে খেতে সে কথায় কান দেয় কখনও, কখনও বা দেয় না।
আজ পুরুষদের দিকে আদিত্য অন্য দিনের চেয়েও বেশি কথা বলছিল। তার বলার বিষয়ের অভাব নেই, এবং ঈশ্বর তাকে লজ্জা সঙ্কোচ দেননি। খেতে খেতে আদিত্য ঘোড়ার কথা বলছিল। বলছিল, এ দেশে ঘোড়ার আদর ছিল রাজপুতদের কাছে, মিডাইভাল যুগে। কারণ, সমস্ত রাজপুতনা আর তার আশেপাশেও যে প্রকৃতি–সে-প্রকৃতি রুক্ষ নির্মম। সে মানুষকে বিশ্বাস করেনি, মানুষকে তার মাটিতে বসাতে চায়নি। চিরকাল সে বিমুখ ছিল–বিমুখতাই তার স্বভাব…।
কথাগুলো জোরে জোরে বলছিল আদিত্য, বলতে বলতে তুষারের দিকে তাকাচ্ছিল। আদিত্যর কথা শুনতে ভাল লাগে। তার কথায় সব সময় হৃদয়ের আবেগ থাকে, সে ভাষায় অলঙ্কার দিয়ে কথা বলে, কিন্তু একথা মনে হয় না, এসব বেখাপ্পা, এসব নাটুকে। ফলে আদিত্যের কথা সবাই শোনে। আজও শুনছিল।
রাজপুতরা কেমন করে তাদের প্রতি বিমুখ প্রকৃতিকে জয় করার জন্যে ঘোড়ার ভক্ত হয়েছিল, ঘোড়াকে খাতির যত্ন করতে শিখেছিল, আদিত্য তার এক বিবরণ দিল। বিবরণ দেওয়া শেষ হলে সে রাজপুত রাণাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘোড়ার নামগুলো একে একে বলে গেল। তারপর থামল, থেমে হাসল হাহা করে বলল, আমি এখানকার সব বিমুখতাকে জয় করব। বুঝলেন, জ্যোতি-স্যার, সেই জন্যে একটা ঘোড়া আনিয়েছি।
জ্যোতি-স্যার কথাটা ঠাট্টা করে বলা। এই রকম ঠাট্টা আদিত্য করে থাকে। জ্যোতিবাবু রাগ করে কি? তুষার জানে না। মনে হয় না রাগ করে, রাগ করার মানুষই নয়।
আদিত্যর কথায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল বোধ হয়। ইঙ্গিত বলে মনে হওয়ার আরও কারণ, আদিত্য কথা বলতে বলতে প্রায়ই চোখ তুলে তুষারকে দেখছিল। তুষার লক্ষ করেছে।
খাওয়ার পর্ব তাড়াতাড়ি সারতে চাইছিল তুষার। তার ভাল লাগছিল না। আশাদির সঙ্গে কয়েকবার চোখাচুখি হল। মনে হল আশাদি বলছেন, বড্ড কথা বলে ভদ্রলোক; এত বাজে কথা মানুষ বলতেও পারে! তুষার মলিনাকে দেখল নজর করে, মলিনা যেন মুগ্ধ চিত্তে আদিত্যর বক্তৃতা শুনছে। কী বিশ্রী!
আদিত্য ঘোড়ার গল্প শেষ করে বলল, জ্যোতি-স্যার কি কখনও ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছেন?
জ্যোতি মাথা নাড়ল। না।
রেস-এ বাজি ধরেন কখনও?
না। জ্যোতি হাসি মুখে বলল।
দ্যাটস অ্যান এনজয়মেন্ট! ..খুব থ্রিলিং। আদিত্য বলল, আমি বার দুই তিন গিয়েছি। একবার প্রায় টাকা চল্লিশেক জিতেছিলাম।
চল্লিশ টাকা। মেয়েদের দিক থেকে মলিনা বলল। এমন আচমকা বলল যে, পুরুষরা সকলেই তাকাল। আশাদি এবং তুষার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তুষারের মনে হল, মলিনা যেন তাদের এই তরফের আভিজাত্য সম্মান রুচি সব নষ্ট করে দিল।