টুসুদের তুলে নিয়ে মজার গাড়ি যখন নিস্তব্ধ ফাঁকা রোদভেজা মাঠ-ঘাট দুপাশে রেখে বিচিত্র দেহভঙ্গি ও শব্দ করতে করতে চলেছে, তখন সমস্বরে ছেলেমেয়েগুলো মজার গাড়ির ছড়া গায়। ছড়াটাও মজার। তুষারকেও মাঝে মাঝে গাইতে হয়। সেই কলকণ্ঠের গীত ছড়ায় অলস মাঠ ঘাট যেন প্রফুল মুখে হেসে ওঠে।
.
০২.
পাহাড়ের মাটি আর কাঁকর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে গাড়িটা শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে থামে সেখানে ছোট বড় কয়েকটা কটেজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আদিগন্ত ফাঁকা মাঠের মধ্যে পাহাড়তলিতে কয়েকটা ছোট ছোট কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে এটাই সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ।
অনেকটা দূরে পাহাড়ের তরঙ্গ, আকাশ এবং মেঘের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কালচে-সবুজ একটি রেখা উত্তর পশ্চিম দিকটা ঢেকে রেখেছে। দিনের আলোয় সবুজ বনানী কার্পেটে তোলা সুতোর কাজের মতন দেখায়, বৃক্ষলতায় ঘন, অস্পষ্ট অবয়ব। বনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঢালু জমি, যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঢেউ ভেঙে পড়েছিল-তার ভাঙন বন এবং বনের পর ঢালু মাটিতে গড়াতে গড়াতে এখানে এসে থেমে গেছে। এখানটা মোটামুটি সমতল। কিছু বৃক্ষ, কিছু পাথর! সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ এই সমতলে পাহাড়তলির নির্জন লোকালয়ের ছবির মতন দাঁড়িয়ে।
ছ-সাতটি কুটির, কটেজের মতন চেহারা; কোনওটা ইটের, পাথর মাটি মিশিয়ে তৈরি; কারও মাথায় খাপরা, কারও মাথায় খড়ের ছাড়ি। ঘন মেটুলি রঙের গা। শালের চারা কেটে কেটে এলাকাটার বেড়া দেওয়া হয়েছে। সামনের দিকের বেড়া বোধ হয় সামান্য বেশি মজবুত, কারুকর্ম কিছু কিছু চোখে পড়বে। শিশুতীর্থরৈ এটা সামনের দিক বলেই হয়তো বেড়ার পাশে পাশে কোথাও জাফরি, কোথাও আকাশ-জালি, ফুল লতা-পাতার বাগান। জাফরি বেয়ে বুনো লতা উঠেছে, আকাশ-জালিতে ছিটফুলের চুমকি, চন্দনের ফোঁটার মতন এক রকমের লতানো ফুল। মাটিতে বিবিধ পাতা গাছ, কোথাও গাঁদা কোথাও কলাফুল কোথাও বা মোরগঝুঁটি–ঋতুর পথ চেয়ে ফোটে, পালা ফুরালে মরে যায়।
শিশুতীর্থর সদর ফটক আছে একটা। কাঠের ফটক। ফটকের মাথায় মালতী লতার টোপর, দুপাশে ঝাউ ঝাউয়ের কুঞ্জ। গায়ে গায়ে জবা গাছ, অপরাজিতার ঝোঁপ। ফটকের মাথায় কাঠের তক্তায় শিশুতীর্থ নামটা ঝুলছে।
কাঁকরে মাটির রাস্তা ফটকের কাছ থেকে আদরে যেন ডেকে নিয়ে এই তীর্থের খানিকটা পৌঁছে দেবে, তারপর আর বাঁধাধরা রাস্তা কোথাও চোখে পড়বে না। হয় মাটি, না হয় ঘাসভরা মাঠ, গাছের ছায়া, এদিক ওদিক মুখ করে আলো-ছায়ায় কুটিরগুলো দাঁড়িয়ে আছে তফাত-তফাত।
এই এই রকম চার পাঁচটি কটেজ এ পাশে, সামনের দিকটায়। পিছনে অনেকটা সবুজ মাঠের ওধারে আরও তিনটি বাড়ি, একই ধরনের অনেকটা, দুটো খুব গায় গায়–অন্যটা গজ পঞ্চাশ তফাতে। সাহেবদাদুর বাড়ি ওরই কাছাকাছি। পুবমুখো টালি ছাওয়া বাড়িটাই সাহেবদাদুর। ছোটখাটো বাসা, সামনে পিছনে বাগান।
ঘরগুলোর পরিচয় দেওয়া দরকার। সামনে দিকের বাড়িগুলো ক্লাসরুম। লম্বা লম্বা চেহারা, উঁচু উঁচু মাথা, দেওয়ালের গায়ে বড় বড় জানলা। জানলায় খড়খড়ি। রোদ বাতাস খেলা করে ঘরে, জানলা দিয়ে গাছের ডাল-পালা দেখা যায়, আকাশ চোখে পড়ে।
এক মাঠ তফাতে পিছন দিকের তিনটে বাড়ির দুটোতে থাকে কিছু ছেলে, দুজন শিক্ষক। সাহেবদাদুর বাড়ির কাছাকাছি লম্বা বাড়িটায় আশাদি আর রেবা। ঝি-চাকররা ওই বাড়িরই একপাশে ঘর পেয়েছে, রান্নাঘরটাও বাড়ির গা লাগানো, ছেলেদের খাবার ঘর ওখানে।
সাহেবদাদুর কথা সামান্য বলতে হয়। গায়ের রং এবং মুখের গড়ন অনেকটা সাহেবদের মতন বলে ছেলেমেয়েরা এই ডাক শুরু করে দিয়েছিল কবে সেই থেকে উনি সাহেবদাদু। সাহেবদাদুর বয়স হয়েছে, এখন বোধ করি প্রায় সত্তর। বার্ধক্য-হেতু চলাফেরা করেন খুব কম। চাকা গাড়িতে বসে মাঝেমাঝে তাঁর শিশুতীর্থের চারপাশ দেখে বেড়ান। অসুস্থ থাকলে বাড়ির বারান্দায় শুয়ে থাকেন, শুয়ে শুয়ে শিশুতীর্থের মেলা দেখেন।
সাহেবদাদুর পূর্ব পরিচয় ছিল, সে-পরিচয় তিনি কাউকে জানানো প্রয়োজন মনে করেন না। একদা কেমন করে যেন এসে পড়েছিলেন এদিকে। জায়গাটা ভাল লেগে গিয়েছিল। বছর কয়েক পরে আবার এলেন, সঙ্গে মাত্র একটি ভৃত্য। ছোটখাটো একটি মাথা গোঁজার জায়গা করে ঈশ্বর উপাসনায় মন দিতে চেয়েছিলেন; মন বসেনি। হঠাৎ কিছুদিনের জন্যে কোথায় চলে গেলেন, ফিরে এলেন মাসান্তে। সঙ্গে একটি শিশু। এই শিশুই তাঁর শেষ জীবনের মায়া মোহের শিকড় হয়ে তাঁকে এখানে বেঁধে রাখল, শান্তির স্বাদ জাগাল।
কোনও কোনও মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে শিউলি ফুলের তুলনা করা চলে। এরা অবেলায় ফোটে, যখন আর দিনালোক নেই, সন্ধ্যা নেমেছে তখন ফুটে ওঠে, অন্ধকারে সৌরভ বিলোয়, তারপর সকালে ঝরে যায়। সাহেবদাদুর জীবনের দিকে তাকালে মনে হবে, দিনান্তে তিনি যেন তাঁর হৃদয়ের আকুলতা অনুভব করে এই শিশুতীর্থ গড়তে চেয়েছেন, এখন সেই পুষ্প বিকশিত। উষাকালের মুখ চেয়ে বসে আছেন এবার তিনি। এই তীর্থের মাটিতে ঝরে যাবেন।
আমি ছিলাম ভবঘুরে সাহেবদাদু একদিন আশালতাকে বলেছিলেন মৃদু আচ্ছন্ন গলায়, কে জানত বল, তোদের এই পাথুরে মাটিতে আমার পা এমনি করে গেঁথে যাবে! ১৬