খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলোর খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার কথা। যা দস্যি সব, শোয় না, ঘুমোয় না–চুপ করেও থাকে না। কেউ লুডো খেলে, কেউ স্নেক ল্যাডার; নয়তো মাঠে ছুটবে, টেনিস বল নিয়ে ফুটবল খেলবে। আজ ওদের শান্ত করতে পারলে তুষার নিজের ছোট ফালি-ঘরে গিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে নেবে একটু।
টেনে টেনে চুল আঁচড়াচ্ছিল তুষার। এলো চুলই থাকবে। একটা গিট দিয়ে নেবে দুপাশের দুগুচ্ছ চুল এনে। রোজই তাই করে। সারা দুপুর বিকেলে চুল শুকোয়, বাড়ি ফিরে তবে বিনুনি বা খোঁপা বেঁধে নেয়।
পুজোর ছুটির জন্যে আজ সকাল থেকেই তুষার কেমন ছেলেমানুষদের মতন কাতর হচ্ছিল, আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। পুজো খুব কাছে। আর বুঝি বিশ বাইশটা দিন। এখানে আকাশ যেন অপরাজিতা ফুলের পাপড়ির আগার মতন বেগুনেনীল; কী নির্মল নয়ন জোড়ানো, হালকা তুলোর মেঘ কোথাও কোথাও রোদে গা ভাসিয়ে শুয়ে আছে, রোদের রং সোনার মতন, বর্ষার শেষে গাছপালা মাঠ সবুজ, সবুজে রোদ পড়ে সর্বত্র একটি আভা ঠিকরে উঠেছে। আর এই বাতাস বার বার শরতের সেই সুগন্ধ এনে দিচ্ছে।
তুষার আজ শিশুতীর্থ আসার পথে বাইরে প্রকৃতি দেখতে দেখতে অনুভব করল, তার মন এখন সব দায় দায়িত্ব ভুলে গিয়ে নিভৃত বিরাম চাইছে। প্রত্যহের এই পুনরাবৃত্তি থেকে কিঞ্চিত বিরাম।
আশাদি বারান্দায়, তার গলার আওয়াজ শোনা গেল। মনে মনে কথা বলে আশাদি, অথচ সে কথা উচ্চস্বর হয়ে ওঠে। তুষার শুনল শুনল না,তার কানে ভাসা ভাসা ভাব একটা কথা গেল শুধু, মলিনা…।
সামান্য পরেই আশাদি ঘরে এল। আলগা অগুছালো শাড়িতে আশাদিকে বউ বউ দেখাচ্ছে। আয়নার এক পাশে চোখ করে তুষার আশাদিকে দেখল। তার হাসি পাচ্ছিল, মজা লাগছিল দেখতে।
তোর চুল আঁচড়ানো হল? আশাদি বললেন।
হ্যাঁ। হয়েছে। বলে তুষার আয়না থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাল।
গা থেকে শাড়ির আঁচল আলগা করে আশাদি সেমিজের ওপর জামা পরছিল।
আশাদি?
বল।
তুমি রঙিন শাড়ি পরে বাইরে যাও না কেন? তুষার শুধোল।
হাত গলিয়ে জামা গায়ে পরে নিয়ে আশাদি তুষারের দিকে না তাকিয়ে বলল, সেফটিপিন দে তো৷।
তুষার উঠে নিজের বেতের টুকরি থেকে চাবির গোছা বের করল। চাবির রিঙে দু একটা সেফটিপিন থাকে।
আশাদির হাতে সেফটিপিন দিয়ে তুষার আবার বলল, রঙিন শাড়িতে তোমায় বেশ দেখায়, আশাদি।
জামায় সেফটিপিন আটকে আশাদি মুখ তুলে তুষারকে দু পলক দেখল। চোখের তলায় সকৌতুক হাসি সামান্য। আয়নার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমাদের কি রঙিন শাড়ি পরার বয়েস আছে রে! বুড়ি হয়ে গেলাম। নিজের চিরুনি খুঁজে নিয়ে আশাদি চুল আঁচড়াতে বসল।
তার চিরুনিটা পরিষ্কার করে জানলা দিয়ে ওঠা-চুলের গুচ্ছটা ফেলে দিচ্ছিল তুষার। আদিত্যকে দেখতে পেল। রান্নাঘরের দিকে গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে মলিনার সঙ্গে। যেমন করে মানুষ রেল স্টেশনের গাড়ি দেখে, সরল কৌতূহলে, তুষার সেই ভাবে আদিত্যদের দেখল। দেখে জানলা থেকে সরে এল।
তোমার যা কথা– তুষার আশাদির বিছানার পায়ের কাছে বসল, সত্যি তুমি রঙিন শাড়ি মাঝে মাঝে পরো, আশাদি। বেশ দেখায়।
কেমন দেখায় শুনি।
আ-হা। কেমন আর? ভাল। তুষার হাসল। বাড়িতে যেমন বউদি-টউদিদের দেখায়।
খুব। আশাদি মোড়া ঘুরিয়ে তুষারের মুখোমুখি বসল, চুল আঁচড়াতে লাগল, তোর দেখি খুব। সাধ।
ওমা, সাধ কীসের। তুষার বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত, দেখতে ভাল লাগে তাই বললাম।
চুলের প্রান্ত বুকের কাছে এনে জটের বাধা ছাড়াতে ছাড়াতে আশাদি বলল, ভাল লাগলেই কি সব করা যায়! বলে দু মুহূর্ত থামল, আবার বলল, রঙিন পরতে আমার বড় লজ্জা করে রে। পরি না তো। এই ঘরে কাপড়-চোপড় ছাড়তে বা বিকেলে পরতে হয়। ঘরে চলে। বাইরে নয়।
তুষার বুঝে পাচ্ছিল না, ঘরে যদি পরা যায় বাইরে নয় কেন? কীসের বাধা?
আশাদি কী ভেবে বলল, এই শাড়িটাও কি সাধে পরেছি। …কাল বিকেলে মলিনা একটা শাড়ি চাইল। দিলাম বাক্স খুলে। তখনই এটায় চোখ পড়ল। কবেকার কেনা জানিস, দু বছর আগে। বাংলা দেশ ছাড়া এশাড়ি তুই পাবি না। পরতে ইচ্ছে হল খুব। হাজার হোক মেয়েমানুষ তো রে…আশাদি হেসে উঠল, শাড়ির লোভ বড় লোভ। কাল সন্ধেবেলায় পরেছিলাম।
তুষার শুনছিল। মলিনার কথায় আবার তার আদিত্যের কথা মনে পড়ল। এখনও কি ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে গাছতলায়? তুষারের ইচ্ছে হল, একবার উঠে গিয়ে দেখে। দেখল না।
চুল আঁচড়ানো শেষ করে আশাদি মুখ মুছে নিল। এখন খেতে যেতে হবে। শাড়িটা বদলে নিলেও চলত, কিন্তু তুষারের জন্যেই যেন, বদলাল না আশাদি; খেয়ে এসে বদলালেই চলবে।
তুষার?
বলো।
একটা কথা বলি তোকে। আশাদি এলো-আঁচলের প্রান্ত কাঁধে উঠিয়ে নিল। জ্যোতিবাবুর আস্কারায় মলিনা যা করছে আজকাল; চোখে লাগে বাপু আমাদের।
কী করছে মলিনা? তুষার তাকাল, তাকিয়ে থাকল অপলকে।
কাল সন্ধের গোড়ায় মলিনা ওই আদিত্যের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে গেল–ফিরল যখন তখন আমরা খেতে বসেছি। কী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে বল তো! আশাদি অনুযোগের গলায় বলল।
তুষার যেন কেমন হতবুদ্ধি,হল। কথাটা বুঝেও না-বোঝার মতন করে বসে থাকল। এখানে এসব ছিল না। …আমি বলছি না এতে কিছু মন্দ আছে, তুষার। কিন্তু মানুষের চোখ বলে একটা জিনিস আছে। দৃষ্টিকটু লাগে। লাগত না, যদি ওরা এখানে আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াত অত রাত না করত। আশাদি যে বেশ অসন্তুষ্ট, ব্যাপারটা পছন্দ করেনি বোঝা যাচ্ছিল।