রাত্রে বিছানায় শুয়ে তুষার অনেকদিন পরে পুরনো কথাগুলো আজ ভাবল। জ্যোতিবাবুকে সে কখনও গভীর করে খুব কাছাকাছি এনে ভাবেনি। কারণ জ্যোতিবাবু তেমন মানুষ যাকে কাছে আনার বা কোনও নিকট সম্পর্কে এনে ভাবার সুযোগ পাওয়া যায় না। তুষারের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর পরিচয় পুরনো, অথচ তুষার কখনও এই শান্ত নম্র ধীর স্থির মানুষটিকে অকারণে মনে করতে পারেনি। অপ্রয়োজনে তার সামনে যেতে বা কথা বলতে পারেনি। তার ফলে পরিচয় সত্ত্বেও, জ্যোতিবাবু তাকে শিশুতীর্থের মায়ায় জড়িয়ে দেওয়ার কারণ হলেও, তুষার ওঁকে দূরে দূরে রেখেছে, তুষার ওঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করেছে। জ্যোতিবাবুকে দেখলে তুষারের মনে যে ভাব হয়েছে তাকে ঠিক কী ভাবে বর্ণনা করা যায় তুষার জানে না। তবু যদি বর্ণনা করতেই হয়, তুষার বলবে, বুঝলি শিশির, তোদের জ্যোতিদাকে মিশনের সাধু-টাধু মনে হয়।
প্রকৃতপক্ষে জ্যোতিবাবুকে তেমন করে কেউ দেখে না। জ্যোতিবাবু কোনও উঁচু জায়গায় চড়ে নেই। খুব সাধারণ সরল কাজের মানুষ। অথচ এই মানুষটিকে কখনও অন্তরঙ্গ ভাবা যায় না, উপায় নেই ভাববার। কেন?
বোধ হয়, তুষার ভাবল, বোধ হয় জগতে এই রকম কিছু মানুষ থাকে, যারা আত্মীয়তা ও প্রীতি সম্পর্কের নাগালের মধ্যে থাকলেও শ্রদ্ধা-সম্মানের পাত্র হলেও, কোনও আশ্চর্য কারণে ঘনিষ্ঠ হতে পারে না।
আদিত্য এবং জ্যোতির তুলনা তুষারের এই মুহূর্তে মনে পড়ল। আকস্মিক ভাবেই।
এদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। তুষার মনে মনে ভাবল, দুই মূর্তিকে দুপাশে দাঁড় করিয়ে যেন দেখল অল্পক্ষণ, তারপর অপ্রসন্ন বোধ করল।
দিদি শিশির কথা বলল।
তুষার তখনও ভাবছিল। অন্যমনস্ক চোখে শিশিরের দিকে তাকাল। শিশিরকে এখন কেমন ছায়ার সঙ্গে জ্যোৎস্না মেশানো ছবির মতন দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো যে কখন জানলা দিয়ে আরও এগিয়ে বিছানায় এসেছে, কখন যে শিশির সেই আলোর দিকে সরে বসেছে তুষার জানে না। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এখন খেয়াল হল।
তোদের পুজোর ছুটি কবে হচ্ছে রে? শিশির শুধোল।
জানি না। তুষার জবাব দিল। কেন?
জিজ্ঞেস করছি।
হবে শীঘ্রি। পুজোর তো আর দেরি নেই।
ছুটি একটু আগে আগে হলে ভাল হয়। বাড়িটায় এবার চুনকাম করা দরকার। দেখছিস না দেওয়াল-টেওয়ালগুলো কেমন হলদে হয় যাচ্ছে।
তুষার দেওয়ালের দিকে তাকাল। লণ্ঠনের অপ্রচুর আলোয় চারপাশটাই আবছা হয়ে আছে, অন্ধকারই বেশি, দেওয়ালগুলো কালো ছায়ার মতন দেখাচ্ছে।
তোর ছুটি না থাকলে হবে না! শিশির বলল।
গলার হারটায় তুষার অযথা আঙুল দিয়ে ঘষছিল। শিশিরের পায়ের কাছে চাঁদের আলো সাদা লোমঅলা পোষা বেড়ালের মতন যেন ঘুমিয়ে আছে। তুষার অকস্মাৎ অনুভব করল, তার চারপাশে কেমন বেদনার নীরবতা। নিরানন্দের একটি জগতে তারা দুই ভাইবোনে বসে আছে। তারা দেওয়ালে চুনকামের কথা ভাবছে। তারা তাদের গৃহবাসকে হলুদ মলিন বিবর্ণ হয়ে আসছে দেখে উজ্জ্বল করে তোলার প্রয়োজন অনুভব করছে। কিন্তু তা কি সম্ভব?
সহসা বাইরে সাইকেলের ঘন্টি বাজল। চমকে উঠল তুষার। কান পেতে থাকল। তার বুকের শব্দ ঈষৎ দ্রুত, নিশ্বাস অনিয়মিত। কপালে সামান্য উষ্ণতা অনুভব করছিল।
তুষার মনে মনে স্থির করল, আদিত্যকে সে আজ বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। রূঢ় এবং নিস্পৃহ। আচরণ দেখাবে। মানুষটা সহজ সৌজন্যের সুযোগে অনেক বেশি মাথায় উঠেছে। না, তুষার আর ওই লোকটিকে ছেলেমানুষ ভেবে, কৌতুক অনুভব করে, অকারণে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ দেবে না।
বিছানা ছেড়ে ওঠার জন্যে যেন তুষার অপেক্ষা করতে লাগল। আদিত্যকে স্পষ্ট করে তুষার আজ বলে দেবে, সন্ধেবেলায় আমার কাজ থাকে, গল্প করার সময় আমার কই। আপনি বরং অন্য কোথাও…
বাগানে কোনও শব্দ হল না। সাইকেলের ঘন্টি আরও দূরে বার কয়েক বেজে বেজে আর বাজল না। তুষার বুঝতে পারল, আদিত্য নয়। রাস্তা দিয়ে কেউ চলে গেল।
তুষারের উচিত ছিল স্বস্তি অনুভব করা, কিন্তু তুষার স্বস্তি পাচ্ছিল না।
৩. তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল
১১.
আশাদির ঘরে তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল। বাইরের দরজা ভেজানো, ঘরের ভেতর দিকের দরজা খোলা। আশাদি স্নানের ঘরে স্নান করছে, জলের শব্দ ভেসে আসছিল। খোলা জানলার পরদা দিয়ে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল রোদ অনুভব করা যায়। বাইরে একটা ঘুঘু অনবরত ডেকে যাচ্ছে। এই ঘর নিস্তব্ধ। তুষার আঁচলটা গায়ে টেনে নিয়ে বেতের মোড়া টেনে বসল, চুল ঠিক করে নেবে। চিরুনি হাতে উঠিয়ে, আশাদির ছোট আয়নায় নিজের মুখ দেখে তুষার একটুক্ষণ চেয়ে থাকল। তার চোখের সাদা জমির কোণে যেন লালের ছিট লেগেছে। বেশি জল ঘাঁটার জন্যে, নাকি সাবানের ফেনায়, অথবা রোদ লেগে এই লালটুকু হয়েছে, তুষার বুঝতে পারল না। আজ সে খুব জল ঘেঁটেছে, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছে। মাথাটা কেমন ভাব ধরা-ধরা হয়েছিল সকাল থেকেই, রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। যেন ঘুমের মোটা সর কোনও কারণে দুধের সরের মতন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। সকালে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না, বাসের হর্ন শুনে উঠেছে। আজ তার তৈরি হয়ে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
চিরুনি বসিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তুষার অনুভব করল, তার চুল মাথা এখন খুব ঠাণ্ডা। ভাত খাবার পর সমস্ত গা ঘুমের আলস্যে জড়িয়ে ধরবে। ঘুম পাবে খুব।