সংসারটা, বাবার মৃত্যুর পর, জ্যোতির ঘাড়ে পড়ল। দিদি আর ভাগ্নে ভাগ্নি সংসারে, সবে কলেজ ছেড়ে এসেছে ও। কী করবে ভেবে পায়নি। প্রথম প্রথম দু এক জায়গায় কাজ করেছে, ভাল লাগেনি বোধহয়, ছেড়ে দিয়েছে। বাস কোম্পানির এজেন্টগিরি করেছে কিছুদিন, তাও ছেড়ে দিয়েছে পরে। শেষে একটা মনিহারি দোকান খুলেছিল। বছর দুয়েক পরে সে-দোকানও উঠিয়ে দিল।
শেষে শিশুতীর্থ। শিশুতীর্থে জ্যোতিই সব চেয়ে পুরনো, তারপর আশাদি, তারপর তুষার। তুষারকেও জ্যোতিই শিশুতীর্থে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাটা এই রকম। জ্যোতি এই শহরের যে দু পাঁচজনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পরিচিত হয়েছিল, বা যাদের সঙ্গে মোটামুটি তার একটা সৌহার্দ্যর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে শিশির একজন। শিশিরের কোনও বন্ধুর সঙ্গে জ্যোতি একদিন এ বাড়ি এসেছিল। শিশিরকে দেখে কেমন গভীর সহানুভূতি বোধ করেছিল, আর সেই সহানুভূতির দরুন মাঝে মাঝে আসত এ বাড়িতে! তুষারের সঙ্গে পরিচয় সেইসূত্রে।
সাহেবদাদুর শিশুতীর্থে জ্যোতি নিজের জায়গা করে নেবার পর তুষারকেও নিয়ে গেল। কথাটা অন্যভাবেও বলা যায়, বরং সেটাই বলা উচিত। …শিশুতীর্থের তখনও নামকরণ হয়নি, সবে সাহেবদাদু কয়েকটা আদিবাসী ছেলে জোগাড় করে একটা পাঠশালার মতন চালাচ্ছেন, এবং আরও দু পাঁচজন ছেলে জোগাড়ের চেষ্টা করছেন আশপাশ থেকে। এসময় একদিন জ্যোতি বেড়াতে গিয়ে ছিল ওদিক পানে। সাহেবদাদুর সঙ্গে তার চোখের পরিচয় ছিল, বেড়াতে গিয়ে সেই পরিচয় পাকা হল। তারপর সাহেবদাদুর কাছে যাওয়া আসা করে জ্যোতি সাহেবদাদুর কল্পনার কথা শোনে, এবং ক্রমশ ওদিকে জড়িয়ে পড়তে থাকে। সাহেবদাদুই জ্যোতিকে ডেকেছিলেন: তুমি এলে আরও একটু ভরসা পাই জ্যোতি, নতুন করে কিছু কাজও করা যায়।
জ্যোতি শিশুতীর্থের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করল। তারপর শিশুতীর্থ একটু একটু করে বেড়েছে, আর জ্যোতি একে একে তাদের নিয়ে গেছে, তুষারকে মলিনাকে। আশাদিকে সাহেবদাদু নিজেই খুঁজে বের করেছিলেন। প্রফুল্ল গিয়েছে আশাদির ডাকে।
তুষারকে যেদিন শিশুতীর্থের কথা বলেছিল জ্যোতি, তুষার অবাক হয়েছিল। তার ধারণায় আসেনি কেমন করে কী গুণে তুষার শিশুতীর্থে জায়গা পেতে পারে।
আমি! তুষার সবিস্ময়ে বলেছিল।
জ্যোতি নীরব। শিশির পাশে বসে আছে। জ্যোতি শিশিরের দিকে তাকিয়ে, যেন কথাটা সে শিশিরকেই বলেছে।
আমাদের লোকের বড় অভাব। জ্যোতি বলেছিল, ছেলে মেয়ে কিছু হয়েছে, তোক পাচ্ছি না।
তা বলে আমি! তুষার তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিশুতীর্থের কাজ সে নিতে পারে, সে যোগ্যতা তার আছে।
তুমি বেশ ভাল পারবে। জ্যোতি বলল। (জ্যোতি তুষারকে তুমি বলত। ) বলে তুষারের চোখে চোখে তাকিয়ে অনুরোধের মতন করে স্মিত হাসল যেন, তোমার স্বভাব শান্ত।
কথাটা শুনে তুষার হেসে ফেলেছিল, শিশিরের দিকে তাকিয়ে আরও যেন মজা পেল, বলল, শিশির বলেছে বুঝি?
শিশির কেন বলবে, আমি দেখেছি। জ্যোতি মৃদু গলায় জবাব দিল, তুমি আমাদের শিশুতীর্থ দেখেছ? দেখোনি। দেখলেই বুঝতে পারবে–এ অন্য ধরনের কাজ। স্বভাব মন ইচ্ছা থাকলেই আমাদের কাজ হয়।
আমি নিজেই কিছু জানি না, অন্যদের কী পড়াব?
না পড়ালে। তোমার যা জানা আছে তাই শেখাবে ওদের। জ্যোতি যেন নিঃসন্দেহ, তুষার পিরবে; নিঃসন্দেহ বলেই আর কথা বাড়াতে চাইল না।
মনে মনে তুষার ঈষৎ রোমাঞ্চিত হলেও ভরসা পাচ্ছিল না। তা ছাড়া শিশির আছে; শিশিরকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে সে কী করে সারাদিনের মতন বাইরে যেতে পারে। নুটুর গাড়ি তখনও আসত না। তাকে কে নিয়ে যাবে, কী ভাবে সে যাবে! সমস্যা অনেক। আমায় দিয়ে হবে না।
হবে। না হলে শিখিয়ে নেব। জ্যোতি শান্ত করে হাসল, বলল, কাজটাকে কাজ মনে কোরো না। তোমায় আমরা টাকা পয়সা দিতে পারব না। যদি মন ভরে, ভাল লাগে তুমি নিজেই সব পারবে।
তুষার নীরব ছিল। তার ভাল লাগবে কি!
শিশির হঠাৎ কথা বলল। বলল, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকিস তুই। একবার এ-ঘর, একবার ও-ঘর করিস। এ তোর ভাল লাগবে দিদি। সময়টা কাটবে।
তুষার আর আপত্তি করেনি।
কিন্তু শিশুতীর্থ তুষারকে সামান্য দিনেই মোহের মতন টানল। তুষার ভাবেনি, তার সাধ্য আছে; তুষারের সন্দেহ ছিল–এই কাচ্চাবাচ্ছাদের নিয়ে তার দিন কাটবে কিনা; এবং তুষার ভেবে ছিল, জ্যোতিবাবু তাকে দায়ে পড়ে বেশি রকম বিশ্বাস করে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে সে উপযুক্ত পাত্র নয় এটা প্রমাণিত হয়ে যাবে।
আশ্চর্য, তুষার শিশুতীর্থের মধ্যে খাপ খেয়ে গেল। সাহেবদাদু তাকে যাদু করল; সে কী এক পবিত্র গন্ধ পেল এখানে, কীসের আনন্দ, দিন ব্যয়ের সুখ, আত্ম নিবেদনের শান্তি যে তুষার শিশুতীর্থকে তার প্রত্যহের অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলল। সুখ বা শান্তি হয়তো এই রকমই। যে ভেবে নেয় পেলাম সে পায়। কোন গল্পে আছে না, মাটিকে সোনা ভেবে এক ফকির পুঁটলি ভরে মাটি বয়ে গ্রামে ফিরেছিল দীর্ঘকাল পরে। লোকে বলল, হায় বোকা–এ তো মাটি, এতদিন পরে এই মাটি তুমি সোনা ভেবে বয়ে এনেছ! ফকির হাসল, বলল, এই সোনা যে মাটি নয় সেটা বুঝতেই এতকাল বাইরে ছিলাম।
সুখ শান্তিও তেমনি। তুষার ক্রমে ক্রমে ভেবে নিল এই শিশুতীর্থের মধ্যেই সুখ আনন্দ তার। সুখ আনন্দ পেল। তুষার ভেবে নিল, নিজেকে ব্যয় করার এই পথটিই তার মনকে তৃপ্তি দিচ্ছে সুতরাং তুষারের মন ভরে থাকল।