যেদিন তুষার দিদিমণি তৈরি থাকেন, সে দিনও নুটুকে নীচে নেমে এসে প্রাপ্য চা-টুকু এবং দিদিমণির সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু সূর্য-ওঠা-আলোর মতন সকৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করতে হয়।
তুষার দিদিমণি একটা হালকা বেতের টুকরি নিয়ে গাড়িতে নুটুর পাশে এসে বসলেন। নুটুর গাড়ি ছাড়ল।
আজ কেমন একটু শীত, নুটু। তুষারদিদি বললেন হয়তো।
বাদলার ঠাণ্ডা দিদি?
না। এমনি; শিশির বা হিমের হবে।
বাদলার বড় ভয় নুটুর। বাদলার রাস্তা গাড়িটাকে বড় ভোগায়। শিশির কি হিমের ঠাণ্ডা শুনে নুটু নিশ্চিন্ত হয়। অল্প এগিয়ে বলে, বুলুটার গায়ে তবে একটা মোটা কিছু পরিয়ে নেবেন দিদি।
বুলু পাঁচ বছরের মেয়ে, রোগা-রোগা দেখতে, হয়তো কদিন সর্দিকাশিতে ভুগেছে।
তুষারদিদি এক পাশে ঘাড় হেলিয়ে হাসি-স্বচ্ছ চোখে নুটুকে দেখেন, যেন ঠাট্টা করে বলেন, তাই নাকি।
গাড়িটা শহরের চারপাশে টহল মারে তারপর। তুষারদিদিকে প্রায় সব বাড়িতে নামতে হয়, ঢুকতে হয়।
কাঞ্চন মুখ ধুচ্ছে সবে। চটপট তাকে তুষারদিদি নিজেই তৈরি করে নেন। কাঞ্চনের মা রাগ করে বলেন, এই ছেলেকে তুই বাপু নিয়ে গিয়ে রাখ তুষার, আমি আর পারি না। কখন থেকে ঠেলছি, বিছানা ছেড়ে কিছুতেই উঠবে না। ওইটুকু একফোঁটা ছেলের কী আয়েস।
রায়বাহাদুরের নাতি তো। তুষার হেসে বলে, একটু হবে। বলতে বলতে শার্টের সামনেটা কাঞ্চনের প্যান্টে গুঁজে দিয়ে আস্তে করে ঠেলে দেয় তুষার কাঞ্চনকে, চল চল…ছুট দে। কাঞ্চনের বই-খাতার ব্যাগটা নিজেই অনিলার হাত থেকে নিয়ে সদরের দিকে এগোয়।
আর এক বাড়িতে মন্টুকে হয়তো ঘুম থেকেই টেনে তুলতে হয়। মন্টুর মাথার পাশে বসে তুষার ডাকে, এই মন্টু, ওঠ। উঠবি না? আজ লেবুপাতার গল্পটা হবে তোদের।
বিনুর আর সব তৈরি–শুধু চুল আঁচড়ানো হয়নি। রিবনটা বিনুর হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে তুষার তাকে টেনে এনে গাড়িতে তোলে।
পুটুর দুধদাঁত পড়েছে, পুটু ঘুম থেকে উঠে সেই দাঁত পেয়েছে বিছানায়। ইঁদুরের গর্ত খুঁজছে, গর্তে দাঁত না দিয়ে সে যাবে না স্কুলে। তুষার হয় গর্ত খুঁজতে বসল, না হয় পুটুকে বলল, পাগলা ছেলে, এখানে ইঁদুর কই, মাঠে কত ইঁদুরের গর্ত, বড় ইঁদুরচল সেই গর্তে দিয়ে দেব। পুটু সানন্দে মাথা নাড়ল মাঠের ইঁদুর তার যেন বেশি পছন্দ।
এমনি করেই ছেলেমেয়েগুলোকে টেনে-টুনে তুলে আনতে হয়। পথের মধ্যেও তুষারের শত কাজ। নিজের জায়গা ছেড়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বসে কারও মুখ মুছিয়ে দেয়, কোনও মেয়ের চুল আঁচড়ে রিবন বাঁধে, কারও বা জামায় বোতাম বসায়।
তুষারের বেতের টুকরিতে সব থাকে। নিজের একটা শাড়ি, জামা, চিরুনি, ছোট্ট পাউডারের কৌটো, চুঁচ-সূতোটুকটাক আরও অনেক কিছু।
গাড়িটা শহরের এলাকা পেরিয়ে একটা বাঁক নেয় ডান দিকে থাকে রেল লাইন বাঁ দিকে ক্ষেত আর মাঠ। রেল লাইনের পাশে পাশে খানিকটা ছুটে এসে হঠাৎ পথ গোলমাল হয়ে যায়, টিলার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে লাইন পুবের জঙ্গলে অদৃশ্য, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাথর কাঁকর আর মোরম রঙের মাটি মেশানো সড়ক ধরে নুটুর বাস তেঁতুল-ঝোঁপের মধ্যে এসে দাঁড়ায়, ঝোঁপ পেরোলেই দূরে চাঁদমাড়ি পাহাড়। রাস্তাটা এখানে ঢালু। দুপাশে ফাঁকা মাঠ, অল্প-স্বল্প গাছ, টেলিগ্রাফের একটা লাইন রাস্তার গায়ে গায়ে চলে গেছে।
রেলগাড়ির সঙ্গে মজার গাড়ির কোনও কোনওদিন দেখা হয়ে যায়। সাড়ে সাতটার প্যাসেঞ্জার গাড়ি। যতক্ষণ একসঙ্গে ছুটছে ছেলেমেয়েগুলো ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। রেলগাড়িকে হারাবার জন্যে বাচ্চাগুলো একসঙ্গে চেঁচায়: নুটুদা, হারিয়ে দাও, রেলকে হারিয়ে দাও। নুটুও গিয়ার বদলায়, যেন দেখাতে চায় তার গাড়ির শক্তিও কিছু কম নয়। হ্যাঁন্ডিকাপ পেলে নুটু রেলকে হারায়, অবশ্য দেড়শো গজ দৌড়ে নুটু যদি পঞ্চাশ গজ হ্যাঁন্ডিকাপ পায়। রেল হারলে ছেলেগুলোর খুব ফুর্তি। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একসঙ্গে সব কজন কলা দেখাবে আর দুয়ো দেবে রেলকে। রেলের ইঞ্জিনের কাটা-দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় পট্টি বাঁধা ফায়ারম্যান দুয়ো পেয়ে হাত তুলে নাড়ে যতক্ষণ দেখা যায় গাড়িটাকে।
পথটা কিন্তু ভাল। ফাঁকা, শান্ত, স্তব্ধ। রোদ উথলে পড়ছে চারপাশে, মাঠগুলো বেশির ভাগই পতিত, কোনও কোনওটায় ডাল বোনা হয়েছে বা সরষে, মাঠের কোথাও কোথাও কুল অর্জুন আর অশ্বত্থ গাছ। পাখি উড়ে যায়, বাতাসে সরু শিসের ডাক ভাসে একটুক্ষণ, কোথাও বা রাখাল গোরু-মোষ চরাচ্ছে। পথে বয়েল গাড়ির সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে, সকাল বেলা জঙ্গলে চলেছে কাঠ কাটতে, বয়েলের গলায় বাঁধা ঘণ্টা বাজছে, ফাঁকা জায়গায় ঘণ্টার সেই শব্দ চমৎকার শোনায়।
মাইল আড়াই এই ভাবে এগিয়ে আসার পর চোখে পড়বে ছোট্ট একটি গ্রাম। গাড়িটা এখানে থামে অল্প সময়। কুচকুচে কালো চেহারা, ছোট ছোট চুল, বড় বড় চোখ, নাক একটু খাঁদা একটি ছেলে, তারই হাত ধরে গোলগাল মোটা নাদুসনুদুস একটি বাচ্চা মেয়ে এসে উঠবে গাড়িতে। ছেলেটার নাম টুসু, মেয়েটির নাম বেলা।
টুসু একটা ফুল পায় তুষারের কাছ থেকে। কোনওদিন বা বেলাও। তুষারের নিয়ম, ডাকাডাকি না করতেই যে তৈরি হয়ে থাকবে গাড়ির জন্যে, সে একটা ফুল পাবে। অবশ্য তুষারের এই ফুল শেষাবধি আর থাকে নাকাড়াকাড়ি করে ওরা নিয়ে নেয়।