এখানে এসে সে প্রথম প্রথম মানিকতলায় ছুটত। সেই ছোটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। রোজ অত বাসভাড়া কে দেবে? মাঝে-সাঝে এক আধদিন এখনও যায়। খুব কম। এখানে থাকতে থাকতে তার সবই সয়ে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবও জুটেছে। দিন কেটে যাচ্ছে বইকী। কোন জিনিস না সয়ে যায় মানুষের। বাবা মাত্র একটা পা নিয়ে, এই ঘরের মধ্যে বসে জীবন কাটাচ্ছে। মা, যে-মানুষ বরাবর সংসার, রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, ছেলেপুলে আগলে দিন কাটিয়েছে–সেই মানুষ আজ সকাল নটা সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই নাকে-মুখে গুঁজে থলথলে শরীর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ছোটে, ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে সাত আট–কিছুই ঠিক নেই। কলকাতায় গাড়িঘোড়া ধরে বাড়ি ফেরার কি কোনও ঠিক আছে।
বোধনও তো সবই মেনে নিয়েছে, সয়ে যাচ্ছে। এই যে সারা বছর নিত্যদিন খাবার জায়গাটুকুতে ক্যাম্প খাট পেতে শুয়ে থাকা, যেখানে কোনও হাওয়া আসে না বাইরের, ফরফর করে সারা রাত আরশোলা ওড়ে, টিকটিকি ডাকে, ময়লা কাপড়ের, নোংরা বাথরুমের গন্ধ আসে, সেখানেও তো বোধন কেমন ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখে, মন্দ স্বপ্ন, ভাল স্বপ্ন দু রকমই।
আজ সে বাবাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্নই দেখেছিল। শেষ রাতে। তখনই ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ভাল করে ঘুম হয়নি। পাতলা ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুম ছিল। জবাদি কড়া নাড়তেই আজ সে সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেয়েছে। শোনামাত্র উঠেছে। উঠে দরজা খুলে দিয়েছে।
.
বিছানাপত্র তোলা হয়ে গিয়েছিল বোধনের। ক্যাম্প খাটও ভাঁজ করে গুটিয়ে ফেলল।
রান্নাঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া আসছে। এই জায়গাটা এখন বেশ কিছুক্ষণ কয়লার ধোঁয়ায় ভরে থাকবে। সাত সকালে ধোঁয়া নাকে মুখে গেলে কাশি লাগে। বোধন উত্তরের জানলাটা খুলে দিল। যত তাড়াতাড়ি ধোঁয়া বিদেয় হয়।
জানলা খুলতেই উলটো দিকের বাড়ির বন্ধ দরজা জানলা, ময়লার পাইপ, নীচের মাঠে আবর্জনার গাদা চোখে পড়ল। এত সকালেও একজোড়া কুকুর ছোটাছুটি শুরু করেছে।
দরজা খুলে চুয়া বেরোল। তাকাল বোধন।
বাসি মুখ, এলোমেলো চুল, পায়ের দিকে চিট সায়া, একটা আধ ঘেঁড়া শাড়ি আলগাভাবে জড়ানো, চুয়া বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল।
জবা বাসন মাজছে কলঘরে।
চুয়া বাথরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ছটফটে গলায় বলল, তোমার দেরি হবে, জবাদি?
জবা কী জবাব দিল শোনা গেল না।
চুয়া হাই তুলতে তুলতে টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিরক্ত মুখ। দু একবার শব্দ করল বিরক্তির।
জবাদি এত দেরি করে আজকাল– চুয়া বেশ অসহিষ্ণু।
দেরি কোথায়, ঠিক সময়েই এসেছে, বোধন বলল।
একটু চুপচাপ। চুয়া মাথা চুলকে নিল। এই যে ছাই একটা বাথরুম–পারা যায় না।
বোধন কিছু বলল না! দোমড়ানো ক্যাম্প খাটটা চুয়ার তক্তপোশের তলায় রেখে আসতে হবে। বিছানা ঘরের কোণে বাক্সর ওপর।
কাল রাত্তিরে অত হই হই হচ্ছিল কীসের? চুয়া বলল।
কখন?
অনেকটা রাত্তিরে। সি ব্লকের দিকেই মনে হল।
আমি কিছু শুনিনি। চারদিক বন্ধ, এখানে কিছু শোনা যায় না।
চুয়া কাশল, আবার মাথা চুলকোল। চোর ধরেছিল বোধ হয়।
জবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। চুয়া যেন সারাক্ষণ চোখ রেখেছিল, জবা বেরিয়ে আসতেই ধড়মড় করে এগিয়ে গেল।
জবাদি?
বলো।
বাসনগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলাম। দরজা বন্ধ করার শব্দ হল।
বোধন তার গোটানো বিছানা আর খাট নিয়ে ঘরে ঢুকল। জানলার একটা পাট বন্ধ। চুয়া বন্ধ করে শুয়েছিল, না বন্ধ হয়ে গিয়েছে নিজের থেকেই কে জানে! কার্তিক মাস শেষ হল। ঠাণ্ডা মোটেই পড়েনি।
যেখানে যা রাখার রেখে বোধন জানলাটা ভাল করে খুলে দিল। এদিকের জানলা খুললে মাঠ, জলের ট্যাংক, পাঁচিল ডোবা এইসব চোখে পড়ে। দূরে বস্তি, পাঁচিলের ওপাশে, কবেকার একটা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ি, কলোনি। আজ আর আকাশ ঘোলাটে নয়। রোদ উঠছে।
বোধন চোখ সরিয়ে ঘরের মধ্যে একবার তাকাল। ভাঙা তোরঙ্গ, চালের টিন, অচল রেডিয়ো, পুঁটলি বাঁধা পুরনো তুলো, কৌটোবাটা, কাচের বয়াম, ঝুড়ি, জুতোর বাক্স, মায় একটা ইঁদুর মারা কল।
বোধন ব্রাশটা তাক থেকে তুলে নিল। ব্রাশটার কিছু আর নেই, দাঁত মেজে মেজে ছেতড়ে গিয়েছে, ডাঁটিটাও বাসি হলুদের মতন রঙ ধরেছে।
বাইরে এল বোধন। জবাদি রান্নাঘরের দরজা খুলে দিয়েছে। রান্নাঘরের বন্ধ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। তবে ধোঁয়াটা এখন পাতলা।
তাকের ওপর মাজনের কৌটো। সস্তা মাজন। বলে আয়ুর্বেদের মাজন। বাঁ হাতে খানিকটা মাজন ঢেলে নিয়ে বোধন দাঁত মাজতে শুরু করল ব্রাশ দিয়ে। ব্রাশটা এবার ফেলে দিয়ে আঙুল চালাতে হবে। একটা ব্রাশ কিনতে ক পয়সা! তবু কেনা হচ্ছে না।
জবাদি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক প্রস্থ বাসন রেখে, রান্নাঘর মুছে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এবার ঝুমরুদের বাড়ি যাবে।
চলে যেতে গিয়ে দরজার কাছাকাছি থামল জবা। দাদা আমার চিঠি লিখে দিলে না?
ব্রাশ চালাতে চালাতে মুখে থুতু নিয়ে বোধন বলল, দেব। আজই লিখে দেব।
জবাদি চলে গেল। বোধন দেখল। যখন আসে জবাদির পায়ে রবারের ক্ষয়ে-যাওয়া চটি থাকে। এই যে এখন নীচে গেল, চটি পরল না, রেখেই গেল। নীচের বাড়ির কাজ সেরে ওপরে আসবে, বাকি কাজকর্ম সারবে, তারপর যাবার সময় চটিজোড়া পায়ে দেবে। বোধন এক-আধ বার ঠাট্টাও করেছে। জবাদিকে–তোমায় বুঝি চটি পায়ে ওরা ঢুকতে দেয় না জবাদি? তাতে জবাদি যেন লজ্জা পেয়ে বলেছে–জলে জলে কাজ পায়ে কি রাখা যায়