তেতলায় থাকত মা বাবা। দোতলার দুটো ঘরের একটাতে দিদি আর চুয়া, অন্যটাতে বোধন। তখন সবাই বাড়তি ছিল। মানে বাড়তি হয়ে গিয়েছিল। লাহাবাবুদের এই রকম দশ বারোটা ভাড়া বাড়ি। নীচের তলায় এক ভাড়াটে, দোতলা-তেতলা মিলিয়ে অন্য-এক। বাবা বাড়িটা ভাড়া নেয় সংসার বড় হয়ে উঠেছিল বলে। শোভাবাজার থেকে মানিকতলা। ঠাকুমা তখন বেঁচে, পিসিমা বিধবা হয়ে ভাইয়ের কাছে এসেছিল মেয়ে নিয়ে। ততদিনে বোধনরাও সবাই মোটামুটি বড়সড়। লাহাবাবুদের বাড়ি পাওয়া খুব শক্ত। সবাই পুরনো ভাড়াটে, আশি একশো টাকায় শেকড় গেড়ে বসে আছে। কখনওসখনও দু একজন উঠত। বাবার ব্যাঙ্কের একজন বাড়ি ছাড়তেই বাবা সেটা ধরে ফেলল, অবশ্য লাহাবাবুদের সরকারমশাইকে হাত করে। সেই বাড়িতে কত কী হল পর পর। ঠাকুমা মারা গেল। পিসিমা মেয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি অণ্ডালেই ফিরে গেল। বাড়ি তখন থেকেই ফাঁকা। অঢেল জায়গা।
সুখের দিন বলতে সেই সময়টা। বাবা চাকরি করছে ব্যাঙ্কে। পকেটে যেন লক্ষ্মী বাসা বেঁধেছিল। দশ পঁচিশ টাকা কিছুই নয়। বাবা খানিকটা শৌখিন গোছের মানুষ ছিল। মা ভাল শাড়ি জামা পরত, গয়না থাকত গায়, ভাল জরদা দেওয়া পান খেত, বাবার সঙ্গে রিকশা চড়ে থিয়েটার সিনেমা দেখতে যেত শ্যামবাজারে। এমন তরতরে জীবনটা হঠাৎ পালটে গেল। কোন দিক থেকে একটা কালো মেঘ ধীরে ধীরে এসে সব তছনছ করে দিল। কোনদিনই আর ভোলা যাবে না বাবার যা হয়েছিল। ট্রাম ধরতে গিয়ে পড়ে পায়ের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেল। হাসপাতালে কত কাল যে! বাঁচবে কি মারা যাবে বাবা কিছুই ঠিক নেই। একটা পাবাঁ পা হারিয়ে বাবা বাড়ি ফিরল। সেই সঙ্গে মেরুদণ্ড আর কোমরের কাছে কীসের গণ্ডগোল। হাঁটা চলা গেল। চাকরিও আর নেই, থাকলেও কি বাবা আর অফিস যেতে পারত। আসলে বাবা একটা গণ্ডগোলে পড়ে গিয়েছিল আগেই, চাকরি যাব-যাব করছিল, ব্যাঙ্ক বাবাকে সাসপেন্ড করেছিল। ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল বাবা, উকিলবাড়ি ছুটোছুটি করছিল। ওই রকম মানসিক উদ্বেগের সময়, প্রচুর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাগজপত্র সমেত উকিলবাড়ি ছুটতে গিয়েই ট্রামের পা-দানি থেকে পা পিছলে পড়ল।
অতবড় দুর্ভাগ্য এসেছিল বলেই বাবা খানিকটা বেঁচেও গেল। ব্যাঙ্ক বাবাকে যতটা পারল মায়া-দয়াও দেখাল। চাকরি অবশ্য গেল। কিন্তু যেখানে যা পাওনা ছিল মিটিয়ে দিল।
বাবার চাকরি যাওয়া আর পাকাটা পড়া মানে মাথার ওপর সমস্ত আকাশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া। বাড়িতে তখন টাকা-টাকা করে মা মাথা খুঁড়ছে। বাবার যা ছিল শেষ, মার যেখানে যেটুকু সোনাদানা ছিল তাও প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে ধার, ধার ধার। মুদিখানায়, বাজারে, ওষুধের দোকানে পাড়াপড়শির কাছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে পাড়ায় ঘুরতে হত। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়তে পড়তে বছরে গিয়ে ঠেকল। লাহাবাবু বললেন, ভাড়া চাই না; বাড়ি ছেড়ে দিন।
দিন বললেই কি বাড়ি ছাড়া যায়? মা তখন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। মায়ের লেখাপড়া বলতে স্কুল ফাইন্যাল। কোনও রকমে। তাও কোন কালে। সবই ভুলে গেছে। থাকার মধ্যে হাতের লেখা। গোটা গোটা, পরিষ্কার। ওতে চাকরি হয় না। তার ওপর মায়ের বয়েস হয়ে গিয়েছিল; তিন ছেলেমেয়ের মা। মায়ের অবশ্য হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। এর জন্যে মায়ের উদ্যম যতটা প্রায় ততটাই তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী। কুমুদকাকা বলে বাবার এক বন্ধুও পেছনে ছিল। মা চাকরি পেল সরকারি এক দোকানে। কাপড়চোপড়, পুতুল, মুখোশ, এটা-ওটা বিক্রি হয়।
মা চাকরি পেয়ে একটু-আধটু গুছিয়ে নেবার আগেই দিদি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। যার সঙ্গে পালাল তাকে বোধনরা চিনত। বদ্যিনাথ। কোনও কারখানায় কাজ করত। দিদির সঙ্গে বদ্যিনাথের মেশামেশি চলছিল অনেকদিন ধরেই, তবু একেবারে এতটা হবে মা বোঝেনি। চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি করে মা ধাক্কাটা সামলে নিল। সংসারে একজন তোক কমল। সেই যে দিদি চলে গিয়েছিল তারপর আজ পর্যন্ত তার কোনও খবর কেউ জানল না। দিদি চলে যাবার হপ্তা খানেক পরে একটি মাত্র পোস্টকার্ড এসেছিল, পেনসিলে লেখা। আঁকাবাঁকা করে দিদি লিখেছিল, তারা বিয়ে করেছে। তোমরা ভেব না।
না, কেউ আর ভাবেনি। বোধনের তো তাই মনে হয়। কী হবে ভেবে? সে কোথায় কেউ তো জানে । বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে–তাই বা কে বলবে!
দিদি পালিয়ে যাবারও চার পাঁচ মাস পরে এই বাড়িতে উঠে আসতে হল। মা লেগে থেকে থেকে, এর ওর হাতে-পায়ে ধরে বাড়িটা জোটাল। সরকারি হাউসিং। ভাড়া কম। ভাড়ার জন্যে মাথার ওপর বাড়িঅলা বসে নেই। রোজ তাগাদাও দিচ্ছে না।
মা কেমন আশ্চর্য ভাবে মানিয়ে নিল এই বাড়িটার সঙ্গে। বাবার মানিয়ে নেওয়া না-নেওয়ার কথাই নেই। অক্ষম, পঙ্গু মানুষ। যেখানে থাক-সবাই সমান।
বোধন প্রথম প্রথম কিছুতেই এই পাড়া, এই বাড়ির সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারত না। মানিকতলায় যেন তার নাড়ি পোঁতা ছিল। বন্ধুবান্ধব, স্কুল, কলেজ, পাড়ার আড্ডা, মানিকতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে হললা, ছায়া সিনেমা, বিডন স্ট্রিটে মধুদার চায়ের দোকান, তাদের পাড়ার কালী পুজো, সরস্বতী পুজো-সমস্ত যেন মনের সঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো ছিল। তেরো চোদ্দ বছর একটানা থাকার পর পাড়া ছেড়ে চলে আসা। বোধনের কান্না পেত। বুক টনটন করত। তবু তাকে আসতেই হল। না এসে উপায় কী!