বোধন কী যেন বলতে যাচ্ছিল। রীতিমতো রেগেই। বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। চুয়া কী যেন বলল? আমার ইচ্ছেয় হয়েছি–? কথাটা কানে বিশ্রি শোনাল। নোংরা লাগল। কিন্তু কথাটা মিথ্যে নয়। চুয়া চুয়ার ইচ্ছেয় হয়নি, বোধনও। নিজের ইচ্ছেয় মার ছেলে মেয়ে হয়ে তারা জন্মায়নি। নিজের ইচ্ছেয় জন্মাতে পারলে চুয়া কার মেয়ে হয়ে জন্মাত?
বোধন অন্যমনস্কভাবে বোনের মুখ দেখছিল।
.
০৪.
কড়া নাড়ার শব্দে বোধনের ঘুম ভাঙল। জবাদি এসে কড়া নাড়ছে। সকাল হয়েছে। ভোরের দিকেই আসে জবাদি, রোদ ওঠার আগে।
বোধন উঠল। মশারি সরিয়ে বাইরে আসতেই বুঝল, জবাদি ঠিক সময়ে এসেছে, আলো এসময়ে যেমন হয় তেমন।
দরজা খুলে দিল বোধন।
জবা ভেতরে এল। পায়ের চটি খুলে এক কোণে রাখল, রেখে মাথা নিচু করে মশারির দড়ির তলা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
বড় বড় হাই তুলল বোধন। হাত মাথার ওপর তুলে ডাইনে বাঁয়ে হেলে আড়মোড়া ভাঙল। ক্যাম্প খাটে শুয়ে শুয়ে ঘাড় পিঠ মেরুদণ্ড বেঁকে গেল কিনা কে জানে। সকালের দিকে রোজই পিঠ ব্যথা করে।
চোখে ঘুম থাকলেও বোধন আর শোবার চেষ্টা করল না। মশারির দড়ি খুলতে লাগল। দড়ি খুলে বিছানা গুটিয়ে নেবে। তারপর ক্যাম্প খাট। ক্যাম্প খাটটা ভাঁজ করা, ফড়িংয়ের মতন পা। এটা ওটা খুলে, দুমড়ে, ভাঁজ করে গুটিয়ে নিলেই ছোট হয়ে যায়।
বোধন তার বিছানা গোটাতে লাগল।
জবা রান্নাঘর থেকে এঁটো বাসনপত্র বার করে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছে। বাসন-কোষন বার করা হয়ে গেলেই উনুন ধরিয়ে দেবে। দিয়ে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবে। তাতেও রক্ষে নেই, ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া এসে এই জায়গাটা ধোঁয়াটে করে তুলবে।
এক একজনের হাত পা খুব চটপটে হয়। জবাদিরও সেই রকম। উনুন ধরিয়ে কিছু বাসনপত্র তখনকার মতন যা লাগবে–মেজেঘষে তুলে দিতে তার বেশিক্ষণ লাগবে না। এইটুকু সেরে জবাদি নীচের তলায় ঝুমুরদের বাড়িতে কাজ করতে নেমে যাবে, আবার ওপরে আসবে ঘণ্টা দেড়েক পরে।
এই সময়টুকু বোধনদেরও দরকার। জবাদি প্রথম দফার বাসন তুলতে না তুলতেই চুয়া উঠবে, উঠে পড়িমরি করে বাথরুমে ছুটবে। চুয়া বেরিয়ে আসতে না আসতেই বাবা। ততক্ষণে মা উঠে পড়বে।
বাড়ির সবাই জেগে ওঠার পর যা কিছু করণীয়বসা, চা খাওয়া, তরকারি কোটা, মাথার চুলের জট ছাড়ানো–আরও কত কী–সবই প্রায় এই জায়গাটুকুতে। এটা অবশ্য খাবার জায়গা। হাত কয়েক মাত্র লম্বা-চওড়া। উত্তর দিকে একটা জানলাও রয়েছে। জানলা আর দেওয়াল ঘেঁষে সস্তা কাঠের ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর প্লাস্টিকের শিট। গোটা তিনেক চেয়ার, একটা হাতলঅলা–অন্য দুটো মামুলি। সংসারের আরও টুকিটাকি এখানে জমা হয়েছে, তেল চিটচিটে মিটসেফ, লকপকে একটা র্যাক, আনাজের ঝুড়ি, বঁটি।
রাত্রে বোধনকে এখানেই শুতে হয়, ক্যাম্প খাট পেতে। রাত্রে সবার সব কিছু সারা হয়ে গেলে শোও, আর সকালে সবার আগে ওঠো। বোধন উঠে ক্যাম্প খাট না তুললে হাঁটা চলার জায়গা থাকে না। রাত্তিরে চুয়া, মা কিংবা বাবা যখন বাথরুমে যায়–বোধনের টাঙানো মশারির দড়ি মাথার ওপর তুলে গলে যায়, এতে অনেক সময় টান পড়ে বোধনের মশারি খুলে যায়, মশা ঢোকে, ঘুম ভেঙে যায় বোধনের।
এই রকমই চলছে আজ চার পাঁচ বছর। উপায় কী! জায়গা কই এ বাড়িতে? দুটি মাত্র তো ঘর। ছোট ছোট। মা-বাবার ঘরে জায়গা নেই। দু জনের মতন একটা গোবদা খাট, কাঠেরই এক আলমারি, বাক্স তোরঙ্গ! জায়গা কি মাটি খুঁড়ে গজাবে! চুয়ার ঘরেও তাই। সংসারের দশ রকম জিনিস তার ঘরে। কাজের অকাজের। ছোটখাটো একটা তক্তপোশে শুয়ে থাকে চুয়া।
এ বাড়িতে এসে বোধন প্রথম প্রথম ঘরে জায়গা করে নিয়েছিল। চুয়াকে ঠেলাঠেলি করে একপাশে সরিয়ে দিত। চুয়া তার গায়ে পা তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুমোত। মাঝেসাঝে বোধন বোনকে গুঁতো মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সেই চুয়া আর নেই তার তেরো-চোদ্দ বছর বয়েস এখন কুড়িতে এসে ঠেকল। আর দেখতে দেখতে বোধন হল বাইশ।
উপায় নেই, জায়গা নেই বলে বোধনের এখানে শোওয়া, ভাঁজ করা দুমড়োনো ক্যাম্প খাটে। ভাল লাগে না। লাগার কথাও নয়। গরমে ভেপসে মরো, পুরনো টেবিল পাখাটা আর চলে না, বাতাসও আসে না উত্তরের জানলা দিয়ে, সারারাত ঘেমে মরা। বর্ষায় সব স্যাঁতসেঁতে, বাড়ির যত রাজ্যের না-শুকনো শাড়ি সায়াও এখানে মেলে দেয় ওরা; সেই ভিজে কাপড়ের স্যাঁতসেঁতানির সঙ্গে তার দুর্গন্ধও নাকে নিয়ে ঘুমোতে হয় বোধনকে। আর শীত হলে তো কথাই নেই, কী কনকনে ঠাণ্ডা, হবে না কেন? সারাদিনে রোদ ঢোকে না এখানে, পড়ন্ত বেলায় যা ছিটেফোঁটা রোদ। মানুষের শোবার মতন জায়গা এটা নয়। গণ্ডা গণ্ডা আরশোলা উড়ছে, দেওয়ালে টিকটিকি বাড়ছে, বাথরুম থেকে অনবরত দুর্গন্ধ আসছে ভেসে। এখানে রাতের পর রাত কেউ শুতে পারে না। তবু বোধনকে শুতে হয়।
মানিকতলা ছেড়ে আসার পর থেকেই শোওয়া বসার আরাম ফুরিয়ে গিয়েছে। বোধনরা আগে মানিকতলায় থাকত। সারকুলার রোড ঘেঁষে। লাহাবাবুদের ফ্ল্যাট বাড়িতে। দোতলা-তেতলা মিলিয়ে। তেতলায় একটা বড়সড় ঘর, পাশে খোলামেলা খানিকটা চাতাল, একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে জলের ট্যাংক, বাথরুমও ছিল টিনের দরজা দেওয়া। স্নানের ব্যবস্থা তেতলায় ছিল না। বরং বারণ ছিল। সেবারণ অনেক সময় মানা হত না। স্নানের ব্যবস্থা ছিল দোতলায়। দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর। আর-একটা খুপরি মতন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার রাখো। তারই গায়ে ঢাকা বারান্দা আর বাথরুম। বারান্দায় কল ছিল স্নান-টানের জন্যে। তবে পুবের দিকটা ছিল খোলামেলা। বড় বড় টিনের জানলার মতন ব্যবস্থা ছিল পুব দিকে। মেয়েরা স্নানের সময় সেটা টেনে ভেজিয়ে দিত। ঝড়জলেও বন্ধ রাখতে হত জানলাগুলো। শীতের হাওয়া বইলেও।