বোধন জবাব দিল না কথার। দিয়ে লাভ নেই। মা কিছু বোঝে না, বুঝবে না।
চুয়া এল। হাতে গরম জলের ব্যাগ।
সুমতি উঠে বসলেন। দু পা দুপাশে ছড়ানো। পিঠে কাপড় নেই। গায়ের আঁচল কোমরের কাছে জমে আছে। মোটা মোটা হাত, ঘাড়-পিঠ কুঁজো মতন, পেট কী বিশ্রিভাবে ফুলে আছে। এত চর্বি মার হয় কেমন করে। এ সবই জল। জলভরা শরীর।
চুয়া বিছানার কাছে দাঁড়াল। দিয়ে দেব?
দাও। সুমতি পিঠের ওপর ছড়ানো এলো চুল জড়িয়ে নিতে বললেন।
বোধন আর দাঁড়াল না। বাইরে এল। বাবা একইভাবে বসে। ডান হাতে পেনসিল, বাঁ হাতে বিড়ি। বিড়ি হাতে বাবা কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে। কী ভাবছে বাবা বোধন জানে। বাবা ক্রস ওয়ার্ডের শব্দ মেলাচ্ছে, মোর, না সোর, ম্যারি হবে না ক্যারি হবে, অথবা হাউস না মাউস? একটা লোক সারাদিন বসে বসে এই সব করছে। শব্দ সাজাচ্ছে মেলাচ্ছে। এটা না ওটা করছে! ক্রস ওয়ার্ড না থাকলে অঙ্ক মেলাবার ধাঁধা। বাবা কত রকম খোঁজই রাখে এই সব পাজল-এর। রাখে, কারণ বাবার ধারণা একদিন, নিশ্চয় একটা সলিউশান লেগে যাবে, লেগে গেলেই বরাত খানিকটা ফিরে যাবে। ক্রস ওয়ার্ড ছাড়াও বাবা মাঝে মাঝে লটারির টিকিট কেনে। কোথাও কোনও টাকার গন্ধঅলা কিছু চোখে পড়লেই বাবা তাতে লেগে পড়ে। মা গালাগাল দেয় নিত্য। গালাগাল খেয়েও এইভাবে লেগে আছে বাবা। অন্য কোনও উপায় খুঁজে পায় না মানুষটা। অথর্ব, অক্ষম মানুষ আর কী করতে পারে! বাবা রাস্তায় বেরোতে পারে না, ঘুরতে পারে না, ঘরে বসে বসে টাকার স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কী করবে! মাঝে একবার খেয়াল চেপেছিল টাইপ করবে বাড়িতে বসে তাতে যা দু-চার টাকা হয়। পুরনো একটা টাইপ মেশিন কিনে দেবার জন্যে মাকে অনেক বলেছিল। মা দেয়নি। টাকা কোথায় পাবে মা? তা ছাড়া ঘরে বসে টাইপের কাজ চলে না। কে আসবে তোমায় বাড়ি বয়ে টাইপ করতে দিতে।
প্যান্ট জামা ছাড়ার জন্যে বোধন পাশের ঘরে গেল। এবাড়িতে দুটো ঘর। একটা মা বাবার, অন্যটা তাদের। তাদের মানে বোধন আর চুয়ার। অবশ্য ঘরটায় বোধনের দাবি থাকলেও দখল নেই। প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, গামছা–এই যা রাখতে পারে বোধন, নিজের এক সময়কার পুরনো দু একটা বই বা টুকটাক, তা ছাড়া আর কিছু নয়। বোধন এ-ঘরে থাকতে পারে না। থাকা সম্ভব নয়। জায়গা নেই।
জামা খুলে প্যান্ট ছাড়ল বোধন। লুঙ্গি পরল। তারপর গামছা টেনে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
হাত মুখ ধুয়ে বোধন বাথরুম থেকে আসছে, বাবা ডাকল, নিচু গলায়। এমন করে ডাকল যেন মার কানে না যায়। দাঁড়াল বোধন।
দাশুবাবুকে মনে আছে?
বোধন মনে করতে পারল না। কে দাশুবাবু? কোথায় থাকে? মাথা নাড়ল বোধন।
দাশরথিবাবু! কালোমতন দেখতে। লম্বা। ছড়ি হাতে ঘুরতেন। কবিরাজ।
বোধন মনে করতে পারল। কারবালা ট্যাংক লেনের কাছে থাকতেন?
হ্যাঁ। কাল একবার যাও না কবিরাজমশাইয়ের কাছে।
বোধন কিছুই বুঝল না। হঠাৎ কবিরাজের কাছে কেন যাবে!
কবিরাজমশাই একটা মালিশ-তেল দিতেন। আমায় একবার দিয়েছিলেন। হাত মচকে ফেলেছিলাম। গাছগাছড়া দিয়ে তৈরি। তেলের নামটা ঠিক মনে নেই আমার। খুব ভাল ওষুধ। তখন বোধ হয় দেড় কি দু টাকা দাম ছিল। এখন একটা টাকা বাড়তে পারে। দু দিন লাগালেই পায়ের ফোলা ব্যথা সব সেরে যাবে।
বোধন এতক্ষণে বুঝতে পারল। অবাক হয়ে দেখল বাবাকে। মানুষটা পাগল না অন্য কিছু! কোন দাশরথি কবিরাজ, কোনকালে বাবা তাকে চিনত, তার মালিশ আনতে ছুটতে হবে বোধনকে।
মালিশ আমি এনে দিয়েছি, বোধন বলল।
কী মালিশ?
নাম বলল বোধন।
সন্দিগ্ধ হলেন শিবশঙ্কর। ওতে কি কাজ হবে? তার ওপর তোমার মার পায়ে একজিমা ছিল। বেড়ে না যায় অ্যালপ্যাথিতে! অনেক সময় আয়োডিন কম্পাউন্ড মিশিয়ে দেয় মালিশে। একজিমা থাকলে ক্ষতি হয়।
বিরক্ত হল বোধন। দু একদিন দেখা যাক। তাতে আর কী বাড়বে!
কবিরাজমশাইয়ের তেলে বাড়ত না। উপকার হত চট করে।
পরে দেখব।
বোধন আর বাবার সামনে দাঁড়াতে চাইছিল না।
শিবশঙ্কর কিছু বললেন না আর।
মুখ মুছতে মুছতে বোধন ঘরে এল। বাবা যে কোন জগতে থাকে কে জানে! কোথাও কিছু নেই দুম করে দাশরথি কবিরাজের কথা খেয়াল হল। লোকটা এতদিন বেঁচে আছে কি না তাই বা কে জানে! বোধনরা যখন মানিকতলায় থাকত, সারকুলার রোডের গা ঘেঁষে, লাহাবাবুদের ফ্ল্যাট বাড়িতে–তখন কবিরাজমশাইকে সে দেখেছে। তখনই বেশ বয়েস কবিরাজমশাইয়ের। বাবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় ছিল। আজ বছর পাঁচেক হল বোধনরা মানিকতলা ছাড়া। কবিরাজমশাইয়ের কেউ কোনও খবর রাখেনি। হঠাৎ তাঁর কাছে এক শিশি মালিশ-তেলের জন্যে কেন যাবে বোধন! ও-সব কবিরাজি-টবিরাজিতে বিশ্বাস নেই বোধনের। সে যে-মালিশটা এনে দিয়েছে তাতেই বোধহয় সেরে যাবে মা।
চুয়া ঘরে এল। তাকাল বোধন।
মালিশটা লাগাল মা? বোধন জিজ্ঞেস করল।
লাগাবে পরে।
পায়ের ফোলা কালকের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে রে?
কী জানি আমি কিছু বুঝলাম না! চুয়া বিরক্ত। এমনিতেই মরছি, তার ওপর এই এক উপসর্গ হল।
বোধন অসন্তুষ্ট হল। চুয়া আজকাল মার ব্যাপারে গা লাগায় না। যেন মার কী হল না হল তাতে তার আসে যায় না।
তুই কিছুই বুঝিস না? মেয়ে হয়েছিস কেন? বোধন বলল।
হয়েছি তো কী হয়েছে। আমার ইচ্ছেয় হয়েছি! তুমিও তো ছেলে হয়েছ।