সুকুমার বলল, তুই ও বাড়িতে কবে যাবি রে? কাল?
যাব ভাবছি।
ও বাড়ির মাসিমাকে বলবি, আমি আসছি হপ্তায় গিয়ে মেগার টেস্ট করে দেব। বহুত বিল যাচ্ছে।
বোধন নিচু মুখে কাজ করতে লাগল।
আবার কিছু মনে পড়ল সুকুমারের। আরে বোধন, তুই বিনুর কাকাকে ধর না।
মুখ তুলে তাকাল বোধন। কাকা?
ভদ্রলোক বড় চাকরি করে। সুকুমার বলল, কোন অফিসে যেন! চৌরঙ্গিতে অফিস।
জবাব দিল না বোধন।
নিজের মনেই সুকুমার বলল, ভদ্রলোকের স্যাকরিফাইস আছে। বিয়ে থা করেনি। বউদি আর তার মেয়েকে টানছে। তাও নিজের বউদি নয়।
বিনুর নামটা বোধনের মনে এল, বিনতা মজুমদার। বিনুর কাকার নামও জানে বোধন: গিরীন সরকার। বিনু একদিন বলেছিল, তার বাবার পিসতুতো না মাসতুতো ভাই হয় কাকা। বিনুর বাবা আজ দশ বারো বছর হল মারা গিয়েছেন৷
একটা ব্যাপার কিন্তু বোধনের ভাল লাগে না। বিনুর কাকা বিনুর মাকে নাম ধরে ডাকে। অনুপমাকে ছোট করে অনু বলে। কেন বলে? তা ছাড়া বিনুর মা বিধবা। তবু মাছটাছ, পিয়াজ সবই খান। বিনুর মুখেই শুনেছে বোধন।
বোধন বিনুর মাকে ঠিক বুঝতে পারে না।
.
০৩.
বোধন অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে বাড়ি ফিরল। দরজা ভেজানো ছিল। আলো এসেছে। কিছুক্ষণ আগে। বাড়িতে পা দিয়ে বোধন বাবাকেই দেখল।
বাবা নিজের জায়গায় বসে। মিটমিটে আলোটা যেমন জ্বলে তেমনই জ্বলছিল মাথার ওপর।
পায়ের চটিটা খুলে রাখছিল বোধন, দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেল। চুয়া। চুয়া ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করল।
নিচু গলায় বোধন বলল, কোথায় গিয়েছিলি?
হট ওয়াটার ব্যাগ আনতে। তল্লাট খুঁজে বনোদের বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম।
কী হবে ব্যাগে?
মা পায়ে সেঁক দেবে।
চুয়া রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল বোধন বলল, একটা মালিশ এনেছি, মাকে দিয়ে আয়।
চুয়া মাথা নাড়ল। তুমি দিয়ে এসো। চুয়া দাঁড়াল না, রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
মাকে এড়াতে চাইছিল বোধন। মার সামনাসামনি দাঁড়াতে তার অস্বস্তি হয়, বিশেষ করে এখন মা কেমন মেজাজে আছে বোঝাই যায়।
একটু দাঁড়িয়ে থাকল বোধন। বাবাকে আবার দেখল। নিজের কাঠের চেয়ারটিতে বসে বাবা টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে পড়েছে। হাতে পেনসিল। দু টুকরো কাগজ ছড়ানো। সামনে মোটা-সোটা ওয়েবস্টার, একটা পত্রিকা। বাবার পিঠের দিকে দেওয়াল আর চেয়ার ঠেস দিয়ে ক্রাচটা দাঁড় করানো।
বোধন আড়ষ্ট পায়ে মার ঘরে ঢুকল।
মা বিছানায়। পায়ের শব্দেও চোখ খুলল না। শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে।
বোধন মালিশ আর ক্রেপ ব্যান্ডেজ বার করল। একটা মালিশ এনেছি। লাগিয়ে দেখো।
সুমতি তাকালেন। মুখ ঘুরিয়ে ছেলেকে দেখলেন। মালিশের কথা কে বলল?
সকলেই বলল। এটা খুব ভাল। লাগাও, ব্যথা কমে যাবে।
ওষুধ খেয়েছি হোমিওপ্যাথি। অফিসে বলল।
তবু তুমি লাগাও। চুয়া গরম জল করছে। আগে একটু সেঁক দিয়ে নাও। দিয়ে লাগাও। বেশি রগড়ো না। আস্তে আস্তে মালিশ করো। তারপর হট ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে রাখো। ব্যথা কমে যাবে।
সুমতি শুয়েই থাকলেন।
বোধন ব্যান্ডেজ দেখাল। বলল, কাল অফিস যাবার আগে এটা পায়ে বেঁধে নিও। আরাম পাবে।
আরাম? সুমতি বিরক্তিকর মুখ করলেন, আরামের কপাল নিয়েই এসেছি! আরাম দিচ্ছ তোমরা!
বোধন মাকে চটাতে চাইছিল না। বেশি কথাবার্তা মার সঙ্গে বলা যায় না। কীসের থেকে কী হয়ে যায় কে বলবে! কম ঘাঁটানোই ভাল।
বোধন চলে আসছিল। সুমতি যন্ত্রণার শব্দ করতে দাঁড়াল। মার পায়ের দিকটা দেখল। মা এমনিতেই গুছিয়ে শোয় না। আজ কাপড়-চোপড়ের কোনও ঠিক নেই। গোড়ালির অনেক ওপর পর্যন্ত কাপড় উঠে রয়েছে, ফোলা ফোলা পা। ডান পায়ের গোড়ালির ওপর চুন হলুদ মাখানেনা। মনে হল, পায়ের পাতা বেশ ফুলে আছে।
বলবে না বলবে না করে বোধন বলল, একবার দেখিয়ে নিলে হত?
থাক… সুমতি আরও বিরক্ত।
না, অনেক সময় হাড়-টাড় চিড় ধরে যায়, বোধন বলল, কী সব ছিঁড়ে যায় শুনি। ভোগায়।
সে তোমাদের হয়, সুখের শরীরে। আমার হাড়ে কিছু হয় না। আর হলেই বা কী! খাটের ওপর পা তুলে বসে থাকতে তো পারব না। যেমন বরাত করে এসেছি তেমন করেই তো থাকতে হবে।
বোধন চুপ করে থাকল। মার কথার পিঠে কথা বলা মুশকিল। বোবা থাকাই ভাল। বিনুদের বাড়ি থেকে পঞ্চাশটা টাকা আজ পেলে বোধন বলতে পারত, চলোকাল তোমায় ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছি। কাল যদি টাকা পায় বোধন মাকে বলবে। দশ পনেরো টাকা যায় যদি যাক, তবু একবার দেখিয়ে নেওয়া ভাল। জংলির ঠিক এইরকম পা মচকে গিয়েছিল বাস থেকে নামতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্লাস্টার করে রাখতে হল মাসখানেক।
বোধন চলে আসছিল, সুমতি বললেন, পরের বেগার খাটছ, নিজের বাড়ির বেগার খাটতে পারো না? এই পাখাটা কদিন ধরে গোরুর গাড়ির মতন চলছে। চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেরে দিলেও তো পারো। গরমে মরি। ঘুম হয় না রাত্তিরে।
পাখাটা বোধন দেখেছে। সুকুমারদাও দেখে গিয়েছে। এ-পাখা সারার নয়। সারাতে গেলে যা খরচ হবে তাতে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। অনেককালের পাখা। ঠেকা দিয়ে দিয়ে এতকাল চলছে। আর চলবে না।
বোধন কান চুলকোল। সারাতে গেলে অনেক খরচা পড়বে। সুকুমারদার ওখানে হবে না।
যেখানে হবে সেখানে যাও। বাড়ির কাজ করতে বললেই তোমাদের সকলের মুখে এক বুলি, হবে, হচ্ছে না। অকর্মার ধাড়ি যত! .