চোখ খুলল বোধন। যন্ত্রণা এবং ঘোরের মধ্যে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল সব। মাধব আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা আরও হাত কয়েক দূরে। গাড়ির সাদা রং এই অন্ধকারেও বোঝা যায়। বোধন কুমার বিল্ডার্সের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে। তার মাথার দিকে সুরকির তৃপ, ইটের পাঁজা। কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে এখন আর লোকজন যাচ্ছে না, পাশের পথ দিয়ে হন হন করে পালাচ্ছে।
বোধন বুঝতে পারল, এই গাড়ি সে পাবে না। তার ক্ষমতা নেই মাধবদের হাত থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে নেয়। মাকে আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গেল না। মা বাড়িতে বিছানায় শুয়ে বিনা চিকিৎসায় মরবে। বোধন মাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল; পারল না। কিন্তু কেন? ওই গাড়ি তো বোধনের। তারই পাবার অধিকার। কিন্তু কে তার অধিকার দেখছে? শালা শুয়ারের বাচ্চা মাধবরা বোধনের গাড়ি কেড়ে নিল।
পিঠে, কোমরে, পেটে–কোথায় না যন্ত্রণা হচ্ছিল বোধনের? বুক ভেঙে যাচ্ছে। বাঁ হাতের কাঁধের কাছটার হাড় সরে গিয়েছে কিনা কে জানে। চোয়াল টনটন করছে। বোধ হয় গাল চোখ সব ফুলে যাচ্ছে মারের চোটে।
বোধন খানিকটা উঠে বসল। বসে প্রায় ঘোরের মধ্যে জোরে জোরে শ্বাস নিল। কপালের তলায় চোখের ভেতরে টুকরো টুকরো কত কী লাফ মেরে মেরে উঠে আসছে। মা, বাবা। মা অচৈতন্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বাবা মার মাথার কাছে চুপ করে বসে। অ্যাম্বুলেন্স আসার অপেক্ষা করছে। বাবা জানে না, বোধন এখন রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বিনুর মার কথাও মনে পড়ল। বিনুর মা সারা বিকেল অপেক্ষা করেছিলেন সে আসবে বলে। বোধন যেতে পারেনি। বিনুও এখন তার অপেক্ষা করছে হয়তো। কে জানে? সুকুমারদা বোধনের জন্যে হাঁ করে বসে আছে।
কিন্তু বোধন কোথায়? বেদম মার খেয়ে জখম-হওয়া কুত্তার মতন পড়ে আছে। তার সারাদিনের অত চেষ্টায় ছোটাছুটি করে পাওয়া অ্যাম্বুলেন্স বেহাত। কী কপাল করেই এসেছিল সে। তারা। বাবা অক্ষম, অকর্মণ্য হয়ে গেল। মা দুটো ভাতের জন্যে কত কী করল। ছেলে মেয়ে স্বামীকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে মার গায়ের রক্ত জল হল। আজ মা মরছে। দিদিও বাঁচবার জন্যে ঘর ছেড়ে পালিয়ে শেষ পর্যন্ত বেশ্যা। চুয়াও চলে গেল আজ…. কেন, কেন এরকম হবে?
বোধন ধুঁকতে ধুঁকতে কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ছিল। আচমকা তার চোখে পড়ল, তার ডান পাশে ভাঙা দুধের বোতল পড়ে আছে। তলার দিকটা ভাঙা। কাচের ফলাগুলো ছোরার মতন তীক্ষ্ণ। বোধন আর হাতখানেক এপাশে পড়লে ওই ফলাগুলো তার গলায় মাথায় ঢুকে যেত।
হঠাৎ বোধনের মাথায় কী যেন হয়ে গেল। তার চেতনার তলা থেকে অদ্ভুত এক হিংস্রতা, জ্বালা সারা জীবনের, সমস্ত কিছুর ক্রোধ যেন মাথার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিল দপ করে। বোধন আর-একবার দেখল। বোতলের মুণ্ডুটা ধরা যায় হাতে।
বেহুশের মতন বোধন বোতলটা টেনে নিল। মুণ্ডুটা ধরল।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল বোধন। পা শক্ত করল প্রাণপণ। সামনে তাকাল। ওই তো মাধবরা। তবে আয় শালা, শুয়ারের বাচ্চারা। চলে আয়। তোরা ভেবেছিস কী? সব তোদের, আমাদের কিছু থাকবে না?
মাধবের দিকে ছুটে যাচ্ছিল বোধন। শালা, শয়তানের বাচ্চা।
চারদিকে কেমন একটা আঁতকে ওঠার শব্দ হল। কারা যেন সরে গেল। বোধন কোনওদিকে খেয়াল করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান হাতটা ছুড়ল মাধবের দিকে।
পেছন থেকে অন্ধকারে কার হাত নেমে আসছে বোধন জানতে পারল না। হঠাৎ অনুভব করল পেছন থেকে তার কাঁধের কাছে ধারালো ভয়ংকর কী বিধে গেল, গিয়ে তলার দিকে হাতের পাশ দিয়ে নেমে গেল। ভাঙা বোতল পড়ে গেল হাতের মুঠো থেকে।
চিৎকার করে উঠল বোধন। বিকটভাবে।
বোধন দুলছিল, পড়ে যাচ্ছিল, কুঁজো হয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে অন্ধের মতন তাকাচ্ছিল। কিছু নেই। সবই শূন্য। কানে এল, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলছে, ভীষণ চিৎকার করে: হাঠো সব। হাঠ যাও। সামনে সে হাঠ যাও।
গাড়ির শব্দ উঠল আচমকা। গর্জনের মতন।
মুখ থুবড়ে, বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে পড়তে বোধনের মনে হল, অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা দপ করে বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে তারই দিকে এগিয়ে আসছে যেন।
ততক্ষণে বোধন মাটিতে।