একটা শব্দ থামতে না থামতেই আবার একটা। বোমা। বোমা মারামারি হচ্ছে তবে কি ওরাই রাস্তার বাতি নেবাল? ঘর বাড়ির বাতিও তো জ্বলছে না। লোডশেডিং-ই। রজনী আর শান্তদের যে-যুদ্ধ কাল শুরু হয়েছিল, হয়ে বন্ধ হয়েছিল, দু তরফের সুযোগ-সুবিধে বুঝে এখন আবার কি তা শুরু হল? কিন্তু দু দলের যুদ্ধক্ষেত্র তো বাজার নয়, বা এই রাস্তাটও নয়, ইটখোলার কাছে, পাম্প হাউসের দিকে– যেখানে গোটা দুয়েক ভাঙা লরি পড়ে থাকে, আর গেঞ্জি কারখানার কাপড় শুকোয়।
বোধন কিছু বুঝল না। সামান্য ভয়ও হল।
ওই তো একটা গাড়ি এল হেডলাইট জ্বালিয়ে, রিকশাও আসছে একটা। দোকানপত্রও বন্ধ হয়নি। বোধন এগিয়ে চলল। আর কিন্তু বোমা পড়ছে না। ব্যাপারটা কী? এত সহজে যুদ্ধ তো থামে না। ভাবতে ভাবতে আরও কয়েক পা এগুতেই আবার একবার শব্দ। তার পরই হল্লার মতন চিৎকার। এদিকে ওদিকে। দূরে কিছু একটা হচ্ছে। লোকজন এ-পাশেই চলে আসছিল।
বোধন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু তার দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। মোড় পর্যন্ত যাওয়া দরকার। অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা যদি দেখতে পায়!
একটু ভাবল বোধন। তার ভয় কীসের? সেনা রজনীদের না শান্তদের দলের লোক। সে এই পাড়ার ছেলে। সবাই তাকে চেনে। সে আজ সাঙ্ঘাতিক এক বিপদে পড়ে রয়েছে। তার মা সকাল থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বাড়িতে। মাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। বোধন অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্স করে দুপুর থেকে পাগলের মতন ছোটাছুটি করছে। তার ওপর কে বোমা ছুড়বে, কেনই বা ছুড়বে! বোধন তো কারও শত্রু নয়। তা ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সব কিছুর বাইরে। অসুস্থ, মুমূর্ষ, মানুষকে বয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে কেউ বোমা ছুড়বে না।
আর বোমা-টোমা পড়ছিল না। তবে হললা ছিল।
বোধন এগুতে লাগল দুপাশে চোখ রেখে। গঙ্গাপদর দোকান আধ-খোলা, লণ্ঠন জ্বলছে, মতি স্টোর্স মোমবাতি জ্বালিয়েছে গোটা কয়েক। এক জোড়া কুকুর ছুটছে। সবই যে বন্ধ তা নয়। তবে সবই খানিকটা তটস্থ হয়ে আছে।
এগুতে এগুতে বোধন প্রায় মোড়ের কাছে চলে এল।
বড় রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে। হর্ন শোনা গেল। গাড়ির আলো ছুটছে বড় রাস্তায়।
আরও কয়েক পা এগিয়ে আসতেই বোধন দেখল, তার মনে হল, একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি ঠিক মোড় পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তা হলে শেষ পর্যন্ত এসেছে। সারা দুপুর আর বিকেলের উৎকণ্ঠা আর ভার যেন বুক থেকে হালকা হয়ে গেল। আবার পরমুহূর্তে বুকটা টনটন করে উঠল। তার মাকে নিতে গাড়ি এসেছে। মা চলে যাবে। এতক্ষণ তবু মা বাড়িতে ছিল। ঘরে। চোখের সামনে। ওই গাড়িটা এসে গিয়েছে। আর মা থাকবে না।
বোধনের গলার কাছে ভয় আর কান্না লাফ মেরে উঠে এল। তারপর তার মনে হল, কেঁদে লাভ নেই। ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে মা বাঁচবে না। বাবাও তো হাসপাতালে ছিল কত দিন! গাড়িটা এসেছে। মাকে নিয়ে যাবে। মা বাঁচবে। এই গাড়ির জন্যে তো তারা দুপুর থেকে পথ চেয়ে বসে আছে।
প্রায় ছুটতে ছুটতে বোধন অ্যাম্বুলেন্সের সামনে এসে দাঁড়াল।
অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি, গাড়ি ঘিরে রজনীর কয়েক জন সাকরেদ দাঁড়িয়ে আছে। কচাকেও তার মধ্যে চোখে পড়ল। কচা, মাধব, তিনু, গোপাল আরও কেউ কেউ। তারা কেন অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বোধন বুঝল না। বোধ হয় পাড়ার মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে বলে তারা অ্যাম্বুলেন্সকে এই সময় ঢুকতে বারণ করছে। বা অন্য রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঘুরে যেতে বলছে।
বোধন একেবারে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল, এই যে আমি! মার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলাম। আমি ওদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি গাড়ি।
বোধনের কথা কেউ শুনল বলে মনে হল না। আগেই দেখেছিল তাকে। গ্রাহ্য করল না। নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিল। ব্যস্ত, উত্তেজিত।
বোধন কিছু বুঝতে পারছিল না। গাড়িটাকে এরা অনর্থক দাঁড় করিয়ে রেখেছে কেন? সামনেই মাধব। মাধবকে বলল বোধন, বাপার কী! গাড়িটা আটকে রেখেছে কেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি রাস্তা ঘুরিয়ে।
মাধব তাকাল। তুমি অন্য গাড়ি দেখো।
বোধন অবাক হয়ে গেল। তার মানে? এ-গাড়ি তবে কার? বোধন বলল, আমি দুপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। আমার মা অজ্ঞান হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
মাধব কচাদের কী বলতে লাগল, বোধনের কথা কানেই তুলল না।
ব্যাপারটা কী? বোধন চটে গেল।
কীসের?
গাড়িটা ছেড়ে দাও। মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আমায়।
অন্য গাড়ি দেখো।
কেন এ গাড়ি কার?
মাধব কোনও জবাবই দিল না।
বোধনের কি তবে ভুল হল? এ-গাড়ি তার নয়? ছুটে সে গাড়ির ড্রাইভারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পাকা পাকা চুল ড্রাইভারের, বুড়োটে মুখ। পাশে একটা লোক। ব্যাকুল, বিভ্রান্ত গলায় বোধন বলল, দাদা, আমি গভর্নমেন্ট হাউসিং থেকে ফোন করছিলাম। দুপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করছি। বোধন চৌধুরী ব্লক সি, দোতলা। আমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ওহি লোকদের বলুন। আমি বাবু অর্ডার মাফিক এসেছি, লোকটা বলল। বোধ হয় অবাঙালি।
আমাদের জন্যে তো! গাড়ি আমাদের জন্যে…
হ্যাঁ হ্যাঁ, বুধন চৌধুরী…
তবে চলুন।
ইসলোক রাস্তামে পাকড়ে নিল। আমি আমি কী করব! রোকতে বলল। রোকে দিলাম। গাড়ি লিয়ে হামলায় পড়ব! সিসাউসা তোড়ে দেবে। বলে খুব নিচু গলায় বলল, রংবাজ পার্টি। হরবখত হামলা মাচায়।