এই ঘর ওই বিছানা-বোধনের আর সহ্য হচ্ছিল না। সে আর দেখতে পারছিল না মার ওই একই ভাবে অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা, বাবার ওই স্থির হয়ে পুতুলের মতন বসে থাকা–ঘণ্টার পর ঘন্টা। সমস্ত ঘরটাও কেমন অসাড়, অচেতন হয়ে আছে। বড় বেশি ঠাণ্ডা, কনকনে লাগছিল। সকালের সেই গন্ধ কখন চলে গিয়েছে বাতাসে, এখন অন্য কোনও গন্ধ উঠছিল, যেন মার বিছানায় কীসের এক দুর্গন্ধ জমে উঠেছে।
বোধন ঘরের চারপাশে অন্যমনস্কভাবে, শূন্য চোখে তাকাল। হলুদ, মিটমিটে আলো। মার শখের দেরাজের মাথায় কত কী পড়ে আছে, আয়না, চিরুনি, চুলের কাঁটা,কাঁচি, মোমবাতি। বেখাপ্পা ভাঙা আলনার ওপর মার শাড়ি, সায়া, জামা। দেওয়ালে ঠাকুমার ছবি। মা বাবা ছেলেমেয়ের মেশানো একটা ধূর ফটো। কালীঘাটের পট। সেলাই মেশিন মা বেচে দিয়েছিল, কিন্তু তার পাদানির ওপর নানা রকম জঞ্জাল জমিয়ে রেখেছে মা।
বোধন আবার বাবাকে দেখল। মানুষটা যেন এখন অনেক ধাতস্থ। কিংবা সমস্ত ভয়-ভাবনা ভুলে গিয়ে বাইরে বাইরে শান্ত ধৈর্যশীল হয়ে উঠেছে। ব্যাকুলতা ততটা নেই যতটা বেদনা; বেদনা যেন শতগুণ হয়ে বাবার মুখ পাথর করে রেখেছে।
সহ্যের সীমা আছে, চোখে দেখার একটা মাত্রা। বোধন আর সহ্য করতে পারছিল না, চোখে দেখতে পারছিল না এই প্রাণহীন, বুক ভাঙা দৃশ্য। তার ভয় করছিল। আর হয়তো মাকে বাঁচানো গেল না। হয়তো ওই ভাবে বাবার কোলের কাছে শুয়ে থেকে থেকে মা চলে যাবে। কেউ কিছু বুঝবে না। কিন্তু বোধন কী করবে? সে তো যা করার করেছে। অ্যাম্বুলেন্স যদি না আসে কী করতে পারে বোধন?
আমি আর-একবার যাচ্ছি বোধন বলল। তার গলা শোনা যায় না।
তাকালেন শিবশংকর। যেন কথাটা শুনতে পাননি।
বোধন আবার বলল, আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি। মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। যদি ভুলটুল করে থাকে, দেখি। এত দেরি কেন করবে?
শিবশংকর স্ত্রীর মুখ গাল থেকে মশা তাড়াতে তাড়াতে বললেন, আয়।
সুকুমারদাকে রেখে যাচ্ছি।
বোধন যাচ্ছিল, শিবশংকর বললেন, চুয়া গেল কোথায়?
জানি না। আমি তো সেই দুপুরের পর থেকে আর ওকে বাড়িতে দেখিনি।
শিবশংকর আর কিছু বললেন না।
বোধনও বুঝতে পারছে না চুয়া কোথায় গেল? সাহা ডাক্তারকে রিকশায় উঠিয়ে বাড়ি ফিরে বোধন চুয়ার ঘরে দরজা খোলা দেখেছে। চুয়া বাথরুমে ছিল। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সের কথা বলে বোধন সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে চুয়াকে আর বাড়িতে দেখেনি। সে কি সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল এসময়?
ঘরের বাইরে এল বোধন। সুকুমার খাবার জায়গায় চেয়ারে বসে আছে। ব্যাঙ্কের কাজ সেরে সে বিকেলের আগেই বোধনের কাছে এসেছে। বসে আছে তখন থেকেই। বসে বসে বোধনকে ভরসা দিচ্ছিল। অবশ্য সে জানে না, সুমতির অসুখটা ঠিক কী!
সুকুমারদা, তুমি তা হলে একটু বসো, আমি ঘুরে আসি, বোধন বলল।
হ্যাঁ, তুই যা। …একেবারে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবি। মুখটাতে। এখানে অনেক সময় রাস্তা ভুল করে।
বোধন চলে যাচ্ছিল। সুকুমার আবার বলল, দোকানে একটু বলে দিবি, বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যেন বলে দেয় আমি এখানে আছি।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল বোধন। হাউসিংয়ের ছোট ছোট টুকরো মাঠে বাচ্চারা খেলা শেষ করে ফিরে গেছে, জলের ট্যাঙ্কের ওপাশে জনা দুই বৃদ্ধ বাড়িতে ঢোকার মুখে শেষ কিছু কথাবার্তা বলছেন। অফিস ফেরত দু এক জনকে চোখে পড়ল!
হাউসিং পেরিয়ে একদিকে খানিকটা মাঠ মতন, অন্যদিকে ঘরবাড়ি। বেশ অন্ধকার হয়ে এল এরই মধ্যে। কুয়াশা জমা শুরু হল। এখনও কাছাকাছি জিনিস চোখে পড়ছে। সামান্য পরে আর পড়বে না। একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে। অ্যাম্বুলেন্সটা এখনও চলে আসতে পারে। আসা উচিত। কখন সে ফোন করেছে অথচ ঘণ্টা চার কেটে গেল। যদি বিপদের সময় না আসে তবে অ্যাম্বুলেন্স কেন? সাজিয়ে রাখার জন্যে? কলকাতায় অ্যাম্বুলেন্স কত কম! আবার বলা যায় না, বোধনদের যেরকম দুর্ভাগ্য তাতে অ্যাম্বুলেন্স আসতে গিয়ে রাস্তায় কোথাও ভেঙে পড়ে আছে কি না!
বোধন সামনের দিকে চোখ রেখে হাঁটছিল, লক্ষ করছিল গাড়ি-টাড়ি কী আসছে! মনুয়াকে দেখতে পেল। সেই একই ভাবে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে, একা একা, খেপার মতন, কোনও দিকে চোখ নেই। মনুয়াকে দেখে বোধনের হঠাৎ কেমন মনে হল, বোধন অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে মনুয়াদের বাড়ি যেতে পারত। ওদের ফোন আছে। মনুয়া তাকে সাহায্য করত। তাড়াহুড়োয় অত মনে থাকে না সব কথা। এত দেরিই যখন হল, বোধন নীলুর খোঁজে গেলেও কাজের কাজ হত। তা হলে অ্যাম্বুলেন্স আর হাসপাতাল দুয়েরই ঝঞ্জাট হয়তো মিটে যেত।
বাজার ছাড়িয়ে যাবার সময় বোধন দেখল, রাস্তার সব বাতি দপ করে নিবে গেল। তার মানে লোডশেডিং। আজ এখনই? অবশ্য লোডশেডিংয়ের তোত কোনও ঠিক নেই। মার ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাবা লণ্ঠনটা জ্বেলে নেবে।
শীতের হাওয়ার সঙ্গে ধুলো, কয়লা, ধোঁয়া সব যেন মেশানো, আগাছার, ডোবার, কতক বা বড়বড় গাছপালার গন্ধও। বিনুদের বাড়ির দিক থেকে ধোঁয়া বেশি আসে রেল লাইনের জন্যে। বিনুর মাকে খবর দেওয়া গেল না আর। বোধনের যে কী হল উনি জানতে পারলেন না।
হন হন করে আরও খানিকটা এগুতেই বোধন একটা শব্দ শুনল। বিকট শব্দ। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল বেশ খানিকটা তফাতে কিছু মানুষজন যেন রাস্তায় নেমে দুরে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ গলিটলিতে ঢুকে পড়ছে। রিকশা সোঁ সোঁ করে চলে গেল।