বাবাকে একবার বলে আসা উচিত বোধন অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে যাচ্ছে।
বোধন দিশেহারার মতন ছুটতে ছুটতে ফ্ল্যাটে ছুটল। সিঁড়ি উঠল লাফ মেরে মেরে।
খোলা দরজা। বোধন হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকল। অ্যাম্বুলেন্স কেমন করে আনতে হয়?
ফোন করতে হবে।
ফোন? বোধন ফোনের কথা ভাবছিল। কোথা থেকে ফোন করবে? ঘোষ কাকাদের ফোন আছে। বাদলদাদের আছে। ওষুধের দোকানেও আছে। সাহা ডাক্তারকেই বললে হত। তিনি বাড়ি থেকে ফোন করে দিতেন।
নম্বর?
ফোন গাইডে পাবে। প্রথমের দিকেই আছে।
আমি তা হলে যাচ্ছি। তুমি একলা থাকবে? চুয়াকে ডেকে দেব?
না। একলাই থাকব।
বোধন চলে যাবার সময় দেখল, চুয়ার ঘরের দরজা খোলা। বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। চুয়া বেরিয়েছে।
চুয়ার ওপর রাগে গা-মাথা জ্বলে যাচ্ছিল বোধনের। কত বড় অসভ্য, শয়তান মেয়ে! বদমাশ, পাজি, উল্লুক কাঁহাকার! তুই এ কী করলি? তোর কি কোনও বোধ বুদ্ধি নেই? এত স্বার্থপর, নোংরা হয়ে গিয়েছিস? তুই বাবাকে অপমান করলি, গালাগাল দিলি। তুই মার সঙ্গে ছোটলোকের মতন ঝগড়া করলি? হাত তুললি মার গায়ে। মাকে বললি, তুমি মরো। কী করে বললি? থিয়েটার করে করে থিয়েটারি কথা শিখেছিস? এত ইতর, এত ছোটলোক হয়ে গিয়েছিস? বস্তি বাড়ির মেয়েরাও তাদের মার সঙ্গে এমন করে কথা বলে না তুই বললি। ঠিক আছে। এর শোধ তুই পাবি। দাঁড়া, মা একটু ভাল হয়ে উঠুক তারপর আমি তোকে দেখব। তোর বড় বড় কথা, থিয়েটারি মেজাজ আমি বার করে দেব। হতচ্ছাড়া, পাজি, বদমাশ মেয়ে কাঁহাকার।
বোধন ছুটছিল। টেলিফোন করবে ঘোষদার বাড়ি থেকে।
সুকুমারদা কখন ফিরবে কে জানে! সুকুমারদা কাছে থাকলে বোধন সাহস পেত। গৌরাঙ্গও নেই। অফিসে।
আচমকা বিনুর মার কথা মনে পড়ল বোধনের। আজ শুক্রবার। বিনুর মাকে নিয়ে আজ বিকেলে তার সোনার দোকানে যাবার কথা। বিনুর মা অপেক্ষা করবেন। হাতে আর সময় নেই বিনুর মার। আসছে শুক্রবারে বিনুর বিয়ে। আজ বিনুও তাকে যেতে বলেছিল। তার কী কথা আছে!
কিন্তু বোধন তো যেতে পারবে না। সে অ্যাম্বুলেন্স ডাকবে। মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। কতক্ষণ থাকতে হবে হাসপাতালে কে জানে। কে বলতে পারে মার কী হবে?
বোধনের হঠাৎ ঠাকুর দেবতা ভগবান কালী শিব জগদ্ধাত্রী কত কী মনে পড়ল। ভগবান কী বিপদ থেকে বাঁচাবেন না? বোধন দুহাত কপালে ঠেকাল। আমার মাকে তোমরা বাঁচিয়ে দাও, ঠাকুর। আমার বাবাকে তোমরা শাস্তি দিয়েছে। মাকে আর দিয়ো না। আমার মাকে বাঁচিয়ে দাও, বাঁচিয়ে দাও।
বোধন শীতের দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে ছুটছিল। হাঁফাচ্ছিল। তার কপাল গাল ঘাড় গলা দিয়ে অনবরত ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।
ছেলেমানুষের মতন বোধন ফোঁপাচ্ছিল আর ছুটছিল।
.
১৭.
বিকেল কখন এসেছিল, এসে চলে গেল বোঝা গেল না। হালকা অন্ধকার দেখতে দেখতে গাঢ় হয়ে আসছিল। শেষ মাঘের শনশনে হাওয়া বিকেল থেকে আরও জোর হয়ে উঠেছে। ৪৮৬
বোধনের অস্থিরতা এখন কেমন যেন শান্ত হয়ে আসছে। হয়তো আর সহ্য হচ্ছিল না বলে, বা শারীরিক অবসাদের জন্যে। আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়? কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় ধৈর্য ধরে?
সুকুমার বলল, কীরে, এখনও পাত্তা নেই?
বোধনের জবাব দেবার মতন কিছু ছিল না। সেই দুপুর থেকে, বড় জোর দুপুরের শেষ থেকে চেষ্টা করছে, তবু অ্যাম্বুলেন্স এল না। দু তিন বার, অপেক্ষা করে, অধৈর্য হয়ে সে ছুটে গিয়েছে ফোন করতে। প্রত্যেক বারই এক কথা: গাড়ি এলে পাঠাচ্ছি। একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ, আমি কত বার ডাকছি বলুন, দুপুর থেকে বসে আছি। কিছু করার দরকার নেই, দাদা; গাড়ি কম। সকাল থেকে দুটো গাড়ি ব্রেক ডাউন। রাস্তায় পড়ে আছে। তারপর শহরের হাল দেখছেন তো। গাড়ি এলে যাবে। অত তাড়া থাকলে সেন্ট জনস-এ ফোন করুন, রিলিফ সোসাইটিতে খোঁজ নিন।
বোধন খোঁজ করে করে তাও করেছে। সব জায়গাতেই একই অবস্থা। গাড়ি নেই। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করছিল বোধন। কিন্তু আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? দুপুর ফুরোল, বিকেল শেষ হল, সন্ধে হতে চলেছে।
তুই ঠিক মতন বলেছিস? রাস্তা বুঝিয়ে দিয়েছিস? সুকুমার বলল।
হ্যাঁ, মাথা নাড়ল বোধন।
তা হলে এত দেরি করছে কেন? ঘণ্টা চারেক হয়ে গেল?
কোনও জবাব দিল না বোধন। সে কেমন করে জানবে কেন অ্যাম্বুলেন্স দেরি করছে।
আমি একবার যাই, দেখি– সুকুমার বলল।
বোধন তাকাল। কী ভাবল। মাথা নাড়ল ধীরে। তুমি বরং বোসো, আমি আর-একবার দেখছি।
কেন, তুই থাক। আমি দেখছি।
না, না। তুমি থাকো। আমার বাড়িতে থাকতে বড় ভয় করছে। বোধন ভীত, বিহ্বল মুখে তাকাল সুকুমারের দিকে। বাড়িতে থাকলেই তাকে মা আর বাবাকে দেখতে হচ্ছে। সে পারছে না। অচৈতন্য মা আর অসহায় বাবাকে সে আর চোখে দেখতে পারছে না।
বেশ। তবে যা তুই। কিন্তু কতবার যাবি আসবি?
বোধন উঠল। উঠে ঘরে গেল। বাতি জ্বালিয়ে দিল। মা সেই একই রকম। সেই ভাবেই বিছানায় পড়ে আছে। বাবা বোধ হয় মার মাথাটা আরও একটু উঁচু করে দিয়েছে নিজের বালিশটা গুঁজে দিয়ে। হাত দুটোকে কোলের কাছে সরিয়ে দিয়েছে সামান্য। পায়ের দিকের কাপড় গুছিয়ে রেখেছে। মার মাথার কাছে চুপ করে বসে আছে বাবা। বসে থেকে কখনও মার কপালে গালে হাত রাখছে, কখনও মাথার চুলে। সেই কখন থেকে বাবা এই একই ভাবে মার মাথার কাছে বসে। সারাদিন মুখে কিছু দেয়নি। বাবাও নয়, বোধনও না। নীচে থেকে ঝমরুর মা মুখে দেবার জন্যে কিছু পাঠিয়েছিলেন, বোধনরা খায়নি, খেতে পারেনি। জবাদি বিকেলের গোড়ায় গোড়ায় এসে খানিকটা চা করে দিয়েছিল, সেটা বোধনরা খেয়েছে।