জবার কিছু করার ছিল না। সে সবই দেখেছে। অত কিছু বুঝতে না পারলেও নীচে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সুমতির ঘরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখছে সুমতিকে। আবার ফিরে আসছে। বোধনকে জিজ্ঞেস করেছে বার কয়েক সুমতির কথা।
দাদা, আমি দুটো ডালভাত করে দিয়ে যাব? উনুনে আঁচ চলে গেল?
না জবাদি, থাক। তুমি বরং যাও। বিকেলে একবার এসো।
বোধন আর দেরি করল না। হাতুড়ে দে-ডাক্তারকে বিশ্বাস নেই। শালা কিছু বোঝে না। আবার সাহা ডাক্তারের কাছে ছুটল। সুকুমারদার কাছ থেকে সে দশ বারোটা টাকা নিয়েছিল। আর কটা মাত্র আছে। দু তিনটে টাকার কথা পরে ভাবা যাবে।
সাহা ডাক্তার এলেন অনেকটা বেলায়। দেখলেন। কখন হয়েছে?
সকালে। বাথরুমে গিয়েছিল… শিবশংকর বললেন বিহ্বল গলায়।
একটা ইনজেকশান শেষ করে আর-একটা তৈরি করছিলেন। প্রেসার চেক করতেন?
শিবশংকর চুপ। সুমতি কিছুই করত না। করতে পারত না।
হসপিটালাইজ করতে হবে, সাহা বললেন। তাঁর চোখের তলায় ঘন উদ্বেগ।
হাসপাতাল? শিবশংকর ভীত, অসহায় চোখে তাকালেন।
অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল, সাহা ডাক্তার দ্বিতীয় ইনজেকশানটা দিতে লাগলেন। সাবধানে, যত্ন করে।
বোধন বিছানার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে। তার বুক ভয়ে কাঁপছিল। মাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে! কেন? কোন হাসপাতালে? কেমন করে পাঠারে? হাসপাতাল কি ভর্তি করবে? বোধন শুনেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও হাসপাতালে জায়গা পাওয়া যায় না। বড় কাউকে ধরলে হয়। বোধন তেমন কাউকে জানে না। এ-দিককার এম এল এ-কে সে চোখে দেখেনি কখনও।
ইনজেকশানের ছুঁচ বার করে নিলেন সাহা ডাক্তার। সুমতির দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। কিছু লক্ষ করছিলেন। তারপর সিরিঞ্জ পরিষ্কার করতে লাগলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ভাবছেন।
বাড়িতে– শিবশংকর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
না না, বাড়িতে নয়। বাড়িতে কখনও নয়।
হাসপাতালে নেবে? বোধনের গলা শুকিয়ে প্রায় বসে গিয়েছিল।
আমি লিখে দিচ্ছি। এমার্জেন্সি কেস। নেবে। আর জি কর-এ যাও, কাছাকাছি হবে।
শিবশংকর ঝুঁকে পড়ে স্ত্রীর মুখ দেখছিলেন। যেন দু দুটো ইনজেকশানের পরও কি সুমতি একবার চোখ খুলে তাকাবেন না? ব্যাকুল, অসহায়, বিভ্রান্ত দৃষ্টি।
ঘরে কেমন একটা গন্ধ উঠছিল অ্যালকোহল কিংবা রেকটিফায়েড স্পিরিটের। গন্ধটা বোধনের নাক থেকে যেন মাথায় চলে যাচ্ছিল। সমস্ত ঘর কী ঠাণ্ডা!
সিরিঞ্জ সাবধানে রেখে সাহা ডাক্তার আবার একবার স্টেথস্কোপ কানে লাগালেন। ঝুঁকে পড়ে সুমতির বুক পরীক্ষা করার সময় মুখ গম্ভীর হচ্ছিল। নাড়ি দেখলেন। ভাবলেন কিছু। নিজের ডাক্তারি ব্যাগ দেখলেন, হাতড়ালেন, বিড়বিড় করে কিছু বললেন, নিজের মনেই।
ভাবলেন আবার। সিরিঞ্জ স্টেরিলাইজ করতে লাগলেন।
বোধনের নীলুর কথা মনে পড়ল। নীলু হাসপাতালে চাকরি করে। নীলুর কাছে যেতে পারলে কিছু হয়। কিন্তু নীলুর এখন ডিউটি, কি ডিউটি নয় বোধন জানে না। তা ছাড়া, অতবড় হাসপাতালে কোথায় সে নীলুকে খুঁজে পাবে! যদি নীলু বাড়িতে থাকত বোধন গিয়ে বললে, নীলু যতটা পারত করত। এখন এসময়ে নীলুর জন্যে ছোটাছুটি করা বৃথা। অনর্থক সময় নষ্ট হবে, কাজ হবে না।
সাহা ডাক্তার তৃতীয় ইনজেকশানের জন্যে তৈরি হলেন।
বোধন জানলার কাছে সরে গেল। নীচে মাঠে চড়ুইয়ের ঝাঁক ঘূর্ণির মতন উড়ে কাঁটা ঝোঁপের গায়ে বসল। আবার উড়ে গেল। প্রতিমাদি ফিরে আসছে। জংলি সাইকেল চড়া শিখছে। বাইরে সব সেইরকম যেমন নিত্যদিন থাকে। তাদের বাড়িতে আচমকা সব পালটে গেল। বোধনের বুক ভারী, ভীষণ ভারী লাগছিল।
সাহা ডাক্তার কখন যে ইনজেকশান শেষ করে প্যাডে খস খস করে লিখছেন বোধন খেয়াল করেনি। খেয়াল হল তাঁর কথায়। লিখে দিয়েছি। এই নাও। …যত তাড়াতাড়ি পারো শিফট করো।
একটা ট্যাক্সি…?
না না, ট্যাক্সিতে নয়। নেভার। ইট মাস্ট বি বাই অ্যাম্বুলেন্স। উইথ অল কেয়ার।
সাহা ডাক্তার তাঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগলেন।
কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? শিবশংকর ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
সেরিব্রাল হেমারেজ।
শিবশংকর নির্বাক। চোখের পাতা পড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত উদ্বেগ, ভয়, বেদনা গলার তলায় আটকে রেখে বললেন, বাঁচবে তো?
সাহা ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। যত তাড়াতাড়ি পারেন। তারপর ভগবান…। চলো বোধন, আমায় একটু নীচে নামিয়ে দাও।
শিবশংকর এমন করে নিশ্বাস ফেললেন, মনে হল তিনি যেন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বোধন বাবার দিকে তাকাল। এমন নিঃস্ব, রিক্ত মূর্তি বাবার সে দেখেনি। বাবার চোখে জল ভরে উঠছিল।
নীচে নেমে হাউসিংয়ের বাইরে আসতেই সাহা ডাক্তার সাইকেল রিকশা পেয়ে গেলেন। ডাকলেন।
ডাক্তারবাবু আপনার.. বোধন আড়ষ্ট গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল।
ঠিক আছে, এখন ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। একটা অ্যাম্বুলেন্সের চেষ্টা করো। মাকে হাসপাতালে পাঠাও। আগের কাজটা আগে করো। সময় নষ্ট করো না। ..পাঠাও। বিকেলে আমায় একটা খবর দিয়ো।
মা বাঁচবে না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাঁচবে না কেন! আগে অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।
সাইকেল রিকশা করে সাহা ডাক্তার চলে গেলেন।
অ্যাম্বুলেন্স কোথায় পাবে বোধন? কেমন করে পাবে? অ্যাম্বুলেন্স সে রাস্তায় দেখেছে আকছার, কিন্তু কোথায় গিয়ে কেমন করে তাদের আনতে হয় সে জানে না। সুকুমারদা থাকলে এসব ভাবতে হত না। নিশ্চয় জানে। তাদের হাউসিংয়ের কাজের লোক কাউকে এখন পাওয়া যাবে না, সব অফিস বেরিয়ে গিয়েছে। বুড়ো রিটায়ার্ড দু একজনকে পাওয়া যাবে। লাহিড়ি জ্যাঠাকে মনে পড়ল তিনি বলতে পারবেন।