বোধন সুমতিকে টানতে টানতে ঘরের দিকে নিয়ে চলল।
চুয়াও তার ঘরে চলে যেতে যেতে বলল, এ বাড়িতে আমি থাকব না আর। যদি থাকি আমার মরা মুখ দেখবে তোমরা।
হ্যাঁ; তাই দেখব। তুই মর।
তুমিও মরো।
চুয়া গিয়ে দরজা বন্ধ করল বিকট শব্দ করে।
শিবশংকর পাথরের মতন দাঁড়িয়ে। তাঁর অসহায়, দীন, করুণ মুখ আরও কাতর, দগ্ধ দেখাচ্ছিল। বিহ্বল, বিমূঢ়। সমস্ত দৃশ্যটাই যেন তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মতন। শূন্য, নির্বোধ দৃষ্টি। অনুশোচনায় বার বার মাথা নাড়ছিলেন।
ঘরে এনে বোধন সুমতিকে বিছানায় বসাল। জল খাবে?
সুমতি মাথা নাড়লেন।
বোধন জল এনে দেখল, মা বিছানায় শুয়ে পড়েছে কেমন ভাবে যেন।
৪. শীতের সকাল
১৬.
শীতের সকাল ফুরিয়ে বেলা গড়িয়ে কখন যে দুপুর হল বোধনরা জানতে পারল না। বাড়ি একেবারে স্তব্ধ, নিঃসাড়। গলা উঠছে না কারও। কী যেন হয়ে গিয়েছে বাড়িতে। আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে দু একজন এসেছিল। দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় নিঃশব্দে চলে গিয়েছে। সুমতি তাঁর ঘরে। বিছানায়। অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছেন, দুপা দুদিকে ছড়ানো, দুহাত বিছানায় যেন লুটিয়ে রয়েছে, কোনও রকমে গায়ে শাড়িটা জড়ানো, চোখের পাতা বন্ধ। খাস আছে। কোনও চেতনা নেই।
সকালে, মেয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির পর সুমতি তাঁর ঘরে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর একবার উঠেছিলেন। উঠে বাথরুমে গেলেন। তারপর হঠাৎ বমি তোলার বিকট শব্দ করতে করতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন, টলে পড়ছেন, শাড়িটাও পরা হয়নি, ধরে রেখেছেন কোনও ভাবে, কী যেন বলার চেষ্টা করছিলেন, হয়তো বলছিলেন–অফিস যাবেন না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, টলতে টলতে গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।
বোধন বাড়িতেই ছিল। শিবশংকর চুপচাপ তাঁর জায়গায় বসে কখনও কপাল আড়াল করছিলেন, কখনও দু আঙুলে চোখের ভুরু টিপে মুখ নিচু করে বসে ভাবছিলেন কিছু, মাথার চুল তুলছিলেন অন্যমনস্কভাবে। চুয়া তার ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কান্না তখনও ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল।
জবা নীচের তলায় কাজ সেরে ওপরে এসে বাড়ির অবস্থা দেখে কী বুঝল সেই জানে, রান্নাঘরে গিয়ে খুটখাট কিছু করছিল।
সুমতিকে ওইভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে যেতে দেখে বোধন মার ঘরে ছুটল।
ততক্ষণে সুমতি বিছানায় শুয়ে পড়েছেন!
বাবা! বোধন ডাকল।
শিবশংকর ক্রাচ টেনে নিয়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে এলেন।
মা কী বলছে?
সুমতি যে কী বলছিলেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, অসম্ভব জড়ানো, অনেকটা তোতলানো কথা; জিব যেন জড়িয়ে বেঁকে যাচ্ছে। বোধ হয় মাথার যন্ত্রণার কথা বোঝাতে চাইছিলেন।
বোধন তাড়াতাড়ি জল এনে চোখে কপালে দিল। পাখা খুলে দিল ঘরের। পাখা চলল না। শিবশংকর হাতপাখা চাইলেন।
চাপা গলায় শিবশংকর ছেলেকে বললেন, রাত্তিরে ঘুমোতে পারেনি, সকালে এই চেঁচামেচি, মাথার আর দোষ কী!
কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
বুঝতে পারছি না। শিবশংকর বিছানার একপাশে, স্ত্রীর মাথার কাছে বসে পাখার বাতাস করতে লাগলেন। হাত দিলেন কপালে। কী হয়েছে, সুমু? ও সুমু?
যে-যন্ত্রণা বোঝানো যায় না–অথচ বোঝাতে চান সুমতি অনেক কষ্টে চোখের কাতরতার মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, তারপর সুমতির চোখের পাতা বন্ধ হল। গালের একটা দিক কেমন মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল, বেঁকে যাচ্ছিল, গলার মধ্যে থুতু জমে শব্দ হল অদ্ভুত।
সামান্য পরেই সমস্ত থেমে গেল; আর কোনও শব্দ নয়, অস্থিরতা নয়, একেবারে স্থির। শুধু শাস প্রশ্বাস পড়ছিল।
ভয় পেয়ে গেল বোধন। সাহা ডাক্তারকে ডেকে আনি, বাবা! মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ভীত, উদ্বিগ্ন গলায় শিবশংকর বললেন, হ্যাঁ, আনো৷বলেই তাঁর টাকার কথা মনে পড়ল। ডাক্তারের টাকা? সুমতির ব্যাগে কী আছে তিনি জানেন না।
বোধন আর দাঁড়াল না।
সাহা ডাক্তার বেলা নটা পর্যন্ত এ পাড়ায়, তারপর চলে যান পুরনো পাড়ার চেম্বারে। ঘণ্টা দুই আড়াই পরে আবার ফেরেন। বোধন সাহা ডাক্তারকে পেল না। নরেন ডাক্তার আটটার পর বেরিয়ে যান হাসপাতালে, ফেরেন দুপুরে। সুকুমারকে দোকানে ধরতে পেরেছিল বোধন। সুকুমার ছোটছুটি করছিল বোধনের সঙ্গে। তার আবার আজকেও ব্যাঙ্কে যাবার কথা। সেই চিঠি নিয়ে ছোটাছুটি করছে কদিন। শেষ পর্যন্ত হাতুড়ে দে-ডাক্তারকেই নিয়ে ফিরল বোধন। সুকুমার বলল, কী করবি, ওকেই নিয়ে যা। আমি কাজ সেরে আসছি। দে-ডাক্তার এল আর গেল। পাঁচটা টাকা পকেটে পুরল। দুটো ওষুধের নাম লিখে দিল।
সুমতির নাকের কাছে আঙুল ধরলে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসটুকু অনুভব করা যায়, বুকে হাত রাখলে হৃৎপিণ্ডের ধাক্কাটুকু হাতে বোধ করা সম্ভব, নয়তো মানুষটাকে মৃত বলেই মনে হত।
শিবশংকর স্ত্রীর মাথায় বাতাস দিচ্ছেন মাঝে মাঝে, চুলে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছেন, কপালে হাত রাখছেন, হঠাৎ হঠাৎ নিচু গলায় ডাকছেন, সুমু? তাঁর চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি উন্মুখ হয়ে প্রত্যাশা করছেন, সুমতি যে-কোনও সময়ে চোখ খুলে তাকাবেন।
বোধন অস্থির হয়ে পড়ছিল। ঠায় মার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। একবার মার ঘরে আবার বাইরে খাবার জায়গায়। চুয়ার ঘরের দরজায় ধাক্কাও দিল বার কয়েক। দরজা খুলল না চুয়া। সে দরজা খুলবে না।