সুকুমার গম্ভীর মেজাজে বলল, বাংলা মুদির দোকানে লেখে। আমাদেরটা ইলেকট্রিক।
বোধন আরও জোরে হেসে উঠল।
খেলা বন্ধ করে দিল সুকুমার। আর দু তিনটে দান হলেই খেলা শেষ হত। জগতের কিছু করার ছিল না। তুই বেটা কাল থেকে লুডো এনে রাখবি দোকানে, তোর সঙ্গে লুডো খেলব। উল্লুক।
জগৎ যেন বেঁচে গেল। সুকুমারদার সঙ্গে দাবা খেলাটাই তার শাস্তি।
সিগারেট খাবি? সুকুমার বলল বোধনকে।
দাও।
জগৎ উসখুস করল। বাইরে যাবে একবার। দোকানের এদিক ওদিক হাতড়ে একটা ভাঙা ছাতা বার করল। তারপর ছুটল।
বোধন সিগারেট ধরিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করতে লাগল।
সুকুমার বলল, একটা বড় কাজ ধরেছি রে? উনিশ নম্বরে বাড়ি হচ্ছে। চাটুজ্যেবাবুর বন্ধু। ইলেকট্রিকের সব কাজ আমার।
বাঃ, ভাল কথা।
আসছে মাসে বিয়েও আছে। পাড়ায় তিনটে বিয়ে, একটা অন্তত পাব, কী বল!
পাবে না কেন! তুমি যে-ভাবে পয়সা ফেলে রাখো বাপিরা পারবে না।
তুই বিজনেসের ঘণ্টা বুঝিস। সুকুমার বলল, আমার বাপও বিজনেস করত। আমি বিজনেসের বাচ্চা। বাবা সাইকেল বেচত। মাসে পাঁচ সাত হাজার টাকার কারবার। ডুবল যখন কাটা ঘুড়ির মতন ফক্কা হয়ে গেল। কিন্তু তোকে বলছি পয়সা ফেলে না রাখলে ব্যবসা হয় না। যার কাছে তুই পয়সা পাবি জানবি সে তোর হাতে আছে।
এটা কী লিখেছ?
লেখাপড়া শিখেছিলি কেন? সব সময়ে এটা কী ওটা কী? বুঝে নিতে পারিস না?
বোধন হাসল। ইস্ত্রি মেরামত করেছিলে ধরবাবুর?
হ্যাঁ।
বোধন বিল লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে বলল, সুভাষ ক্লাব কালী পুজোর টাকা দিয়েছে?
এই হপ্তায় দেবে বলেছে। না দিলে ফকিরের পেন্টুন খুলে নেব। সুকু দত্তকে চেনে না!
বোধন কিছু বলল না।
সুকুমার বাইরের বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল, একটা কথা ভাবছি। দোকানে একটা রেডিও সারাই ডিপার্টমেন্ট রাখলে কেমন হয় রে?
বোধন মজা পেল। দশ হাতের দোকান, তার আবার ডিপার্টমেন্ট। ছোট কথা সুকুমারদা বলবে না। সারাবে কে? তুমি?
তুই।
আমি? বোধন অবাক।
লেখাপড়া শিখলি কেন ফালতু? যেদো মেধো রেডিয়ো সারায়–তুই পারবি না? ম্যাডান স্ট্রিটে যা–দেখবি পানের দোকানে রেডিয়ো সারাচ্ছে। তুই বলিস কীরে? গলায় দড়ি দিগে যা!
বোধন হাসল না। সুকুমারদা এইরকমই। বলল, শিখলে সব কাজই পারা যায়।
তুইও শিখে নিবি। কী আছে শিখতে। আমি একটু আধটু জানি। তোকে দীনুর সঙ্গে লাগিয়ে দেব। দীনু তোকে একমাসে মাস্টার করে দেবে।
বোধন কিছু বলল না।
সুকুমার যেন স্বপ্ন দেখতে দেখতে বলল, দোকানটা বড় করতে হবে রে, বোধন। আমার মা আর বউয়ের মধ্যে রোজ খেচামেচি। মা বর্ধমানে দেশ বাড়িতে চলে যেতে চায়। তা ধর, সেখানে কীই বা আছে। মা যদি যায়–আর একটা বাড়তি খোরপোশর ব্যবস্থা চাই।
বোধন হঠাৎ বলল, তোমার কাছে টাকা আছে?
টাকা! কত?
গোটা দশেক অন্তত।
কী করবি?
মার পা মচকে গিয়েছে। গোড়ালির কাছটায়। ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একটা মালিশ কিনব, আর একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখলে ব্যথা কম লাগবে।
সুকুমার পকেট হাতড়াচ্ছিল। খুচরো নোট, পয়সা সব রাখতে রাখতে বলল, মাসিমা অফিস যাচ্ছে?
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়েছে আজ।
ছুটি নিতে বল। দশটা তো হচ্ছে না রে, সাত হচ্ছে। সাতে হবে?
কী জানি!
না হলে বুড়োবাবুকে বলবি, কাল নেবে। তুই সাহা ফার্মেসিতে যাবি তো? বলবি বুড়োবাবুকে। আমার নাম বলবি।
এইভাবে টাকা নেওয়ায় অস্বস্তি হচ্ছিল বোধনের। কৈফিয়ত দেবার মতন করে বলল, বিদের টাকাটা পাইনি এখনও। আজ গিয়েছিলাম।
পেলি না কেন?
বিনুর জ্বর। ওর মা কিছু বললেন না।
তুই চাইলি না কেন?
বাঃ, কেমন করে চাইব। বিনুর জ্বর!
সুকুমার হঠাৎ হেসে উঠল। তুই যে আমার লাইনে বিজনেস করছিস, বোধন। টাকা ফেলে রাখছিস। তোর হবে।
বোধন লজ্জা পেল। কথাটার কী মানে? বলল, না, সুকুমারদা, আজ আমার টাকার খুব দরকার ছিল। চাইব ভেবেছিলাম। পারলাম না।
সুকুমার টাকা পয়সার সঙ্গে পকেট-চিরুনি বার করেছিল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তা দরকার পড়লে চাইবি না? তোর দরকার। চাইলে কিছু মনে করত না। ওরা তোক ভাল।
বোধন ইস্ত্রি মেরামতের বিল লেখা শেষ করল।
বৃষ্টি কমে আসছে। ছাড়েনি। ঘুটঘুঁটে ভাব যেমন ছিল সেইরকমই।
বলব কি বলব না করে বোধন বলল, তুমি আমায় অ্যায়সা ঝাটে ফেলেছ। পড়ানো-টড়ানো আমার হয় না। ছেড়ে দিতে হবে।
কেন? মাসে পঞ্চাশটা টাকা আসছে।
পড়াতে পারি না। ভুল হয়।
হোক। সুকুমার বলল, কোথায় ঠিক ঠিক পড়ায় রে? স্কুলে পড়ায়? আমাদের এখানকার স্কুলটার হাল দেখছিস না। মাস্টারগুলো ইট মারামারি করে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে পুজোর আগে থেকেই।
বোধন এখানকার স্কুলের ব্যাপারটা জানে। দু দল মাস্টারে মারপিট করেছে। দলাদলির ব্যাপার। স্কুলের কর্তৃত্ব কে করবে তাই নিয়ে লড়াই। পলিটিকস।
নতুন করে একটা বিল লেখা শুরু করল বোধন। এই লেখাটা আন্দাজে পড়তে পারছে সে। হিটার মেরামতি। লিখতে লিখতে বোধনের মনে হল, সুকুমারদার কাছে সে পুরো সত্যি কথাটা বলেনি। আজ তার টাকার দরকার মায়ের জন্যে তেমন ছিল না। বোধনের প্যান্ট নেই, মানে–যা আছে দু তিনটে তার মধ্যে দুটোই ভেঁড়া, রং বলে আর কিছু নেই। বোধন একটা প্যান্ট করতে দিয়েছে। গত হপ্তায় নেবার কথা। নিতে পারছে না। তিরিশটা টাকা লাগবে। টাকা পেলে আজ নিত। নেব বলেছিল দোকানে। হাতে বাকি যা থাকত তাতে মার জন্যে মালিশ হয়ে যেত।