চা আমার দরকার ছিল না, বোধন বলল।
আমার গলায় ব্যথা, গরম চা খেলে আরাম লাগে, বিনু বলল।
চা খেতে খেতে বিনু আরও পাঁচটা কথা বলল, এলোমেলো হালকা কথা।
বোধন চা শেষ করল। আমি তা হলে যাই।
কবে আসবে?
দেখি তোমার তো জ্বর।
ধ্যুত, এ সেরে গেছে। কাল ঠিক হয়ে যাব। …তুমি পরশু এসো।
বোধন হতাশ হয়ে পড়েছিল। টাকাটা কত পিছিয়ে গেল। বলবে নাকি বিনুকে। বিনু বড় সাদামাটা সরল। সে কিছু মনে করবে না। টাকার দরকার মানুষের হতেই পারে। লজ্জার কী রয়েছে?
উঠে পড়ল বোধন। বিনুও।
সদরে এসে বোধন হঠাৎ বলল, মাসিমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
মার সঙ্গে? ডাকব মাকে?
বোধন আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল। না, থাক; আমি বরং কাল একবার আসব।
তাই এসো।
বোধন বাইরে পা বাড়াল।
.
০২.
এখন বর্ষা নয়, যখন তখন বৃষ্টি আসার কথাও না। তবু আজ কদিন ধরেই বর্ষার ভাব চলছে। কার্তিক মাস শেষ হয়ে গেল। আর ভাল লাগে না বৃষ্টি বাদলা।
বোধন খানিকক্ষণ ঘুরে ফিরে, তারা ইলেট্রিকস-এ গিয়ে বসল, ততক্ষণে হালকা বৃষ্টি নেমেছে, পাড়াও ঘুটঘুঁটে। আলো আসতে আসতে রাত নটা দশটা।
তারা ইলেকট্রিকস-এ সুকুমারদা আর জগৎ দাবা খেলছে মোমবাতি জ্বালিয়ে। দোকানটা সুকুমারদার।
বোধনকে দেখল সুকুমার। দেখেও কিছু বলল না। ঘোড়ার চাল নিয়ে মগ্ন। খেলা প্রায় শেষ।
জগৎ তার গজ সামলাচ্ছে।
বোধন একটা টুলের ওপর বসল।
দোকানটা ছোট। থাকার মধ্যে একটা পুরনো কাউন্টার টেবিল, পেছন ভাঙাচোরা আলমারি, ডান দিকে লোহার এক র্যাক। গোটা তিনেক নানান ধরনের চেয়ার, ছোট বেঞ্চি। ঘরাঞ্চিটা একপাশে দাঁড় করানো আছে। সামনেই রাস্তা। লোকজন, সাইকেল রিকশা যাচ্ছে অনবরত।
জগৎ সুকুমারের দোকানের লোক বয়েস কম। জগতের কাজ হল দোকান আগলে বসে থাকা।
সুকুমার বেয়াড়া একটা চাল দিয়ে জগৎর্কে আরও ঝঞ্জাটে ফেলে দিল যেন। দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বোধনের দিকে তাকাল আবার। কী রে, কাজটা করে দে।
এখন?
এখন না কখন? তোর জন্যে বিল ছাড়তে পারছি না। নে লেগে যা…
সুকুমারদার অনেক কিছুতেই বোধনের মজা লাগে। যেমন এই বিল। কোন বাড়িতে একটা সুইচ পালটেছে, কার বাড়িতে লাইনের গণ্ডগোল মেরামত করেছে, কার ইস্ত্রি সেরেছে, কিংবা পাখা মেরামত করে দিয়েছে সব কিছুতেই বিল। তারা ইলেকট্রিকসের ছাপানো পাতায় দুটাকা চার টাকা আট টাকা সব কিছুর বিল লিখতে হবে। হাতে নাতে কাজটা হতে পারত, কিন্তু সুকুমারদা করবে না। বিলে নাকি ইজ্জত বাড়ে। সুকুমারদার দোকানে বালব, ফিউজের তার, প্লাগ, চোক–এসবও কিছু না কিছু বিক্রি হয়। তার বেলাতেও কাঁচা ক্যাশ মেমো। জগৎ ঠিক মেমো লিখতে পারে না,কাঁচা হাতের লেখা, অদ্ভুত বানান–তবু ইংরেজি হরফে ওসব তাকে লিখতেই হবে। সুকুমারদার নিজের হাতের লেখা এবং বানান জগতের বাড়া। ক্যাশ মেমো যেমনই হোক বিল গবেটের মতন লেখা যায় না। তাতে নাকি দোকানের এবং দোকানের মালিকের প্রেস্টিজচলে যায়। কাজেই সুকুমারদা বোধনকে দিয়েই কাজগুলো করিয়ে নেয়, বিল লেখা, খুচরো বিক্রির হিসেব তুলে খাতায় ভরা। বোধনকে সুকুমারদা যখন যেমন পারে পাঁচ দশ দিয়েও থাকে।
এক একজন মানুষ থাকে যাদের হাজার বললেও কিছু বোঝে না। সুকুরমারদা সেই রকম। তার ধারণা, বোধন একজন দিগগজ। বি এস সি পাস করেছে বোধন, সুকুমারদার ধারণা সে সায়েন্স মাস্টার।
আসলে বোধনকে ভালবাসে সুকুমারদা। ভালবাসে, কারণ এই পাড়ার বেশির ভাগ ছেলের মতন বোধন হললাবাজ, রুক্ষ, নেশাখোর, হতচ্ছাড়া নয়। এই ভালবাসার দৌলতেই বোধনের ভাগ্যে বিনু বা বিনুর মার পঞ্চাশটা টাকা জুটেছে একমাস। এ-মাসেও জুটবে। কিন্তু টাকাটা আজ পাওয়া গেল না।
কোথায় কী আছে দোকানের বোধন জানে। খাতাপত্র, তারা ইলেকট্রিকস-এর ছাপানো প্যাড বার করে নিল বোধন।
কটা বিল হবে?
খাতা দেখ। লেখা আছে।
জগৎ পালটা চাল দিল।
সুকুমার মুঠো পাকিয়ে শব্দ করে করে বার দুই টান দিল সিগারেট। পালটা চাল দেখল। নিজের চাল ভাবল। তারপর হঠাৎ মজার গলায় গান গেয়ে উঠল: আয় মা তারা নেচে নেচে…। গান শেষ না করেই জগতের পালটা চাল নষ্ট করে দিয়ে বলল, তোর দ্বারা দাবা হবেনা, জগৎ। তুই বেটা চাইনিজ চেকার খেল। উল্লুক তুই।
জগৎ কিছু বলল না। মাথা চুলকোল। সুকুমারদার ভয়ে তাকে দাবা খেলতে হয়। সুকুমারদার ধারণা, বোকা জগতকে দাবায় নামিয়ে সুকুমারদা তার মাথা সাফ করে দেবে।
বৃষ্টি পড়ছে। খেলা চলছে। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে রিকশা যাচ্ছে ঘন্টি বাজিয়ে।
বোধন একটা পকেট সাইজের খাতা থেকে সুকুমারের হাতের লেখা কাজের ফিরিস্তি উদ্ধার করছিল। এটা কী লিখেছ?
সুকুমার খাতা দেখল। নিজেই যেন বুঝতে পারল না। ঘাড় চুলকোল। ছ নম্বর বাড়িতে কী হয়েছিল রে, জগৎ?
ছ নম্বর! …ওই শ্বেতিবাবুর বাড়ি?
শ্বেতি তো তোর কী শালা। কার শ্বেতি, কার মেতি–তোকে কে দেখতে বলেছে! খদ্দের খদ্দের। খদ্দেরের নামে ফালতু কথা বলবি না।
জগৎ ঘাবড়ে গেল। বলল, বাড়ির কাজ আমি কী জানব?
বারে শালা, দোকান থেকে মাল গেছে, তুই কী জানবি?
বাচ্চু কাজ করেছে ছ লম্বরে। বলেই জগতের মনে পড়ে গেল ছনম্বরে নতুন টিউব লাইট লাগানো হয়েছে। বলল, টিউব লাইট।
বোধন হেসে ফেলল। সুকুমারদা দারুণ লিখেছে খাতায়। ফিশিংটা বোধহয় ফিক্সিং তুমি এসব লিখলে আমি কী বুঝব? বাংলায় লিখে রেখো।