বিনুর মা সামান্য বিরক্ত হলেন হয়তো। পাখা নিবিয়ে দিলেন। দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।
তুমি কি চা বসিয়েছ? বিনু বলল।
চা? …না। কেন!
আমাদের খেতে ইচ্ছে করছে।
আমাদের কথাটায় বোধন অপ্রস্তুত হল। বিনুর মার দিকে তাকাতে পারল না।
এই তো খেলে খানিকটা আগে, বিনুর মা বললেন।
এই তো কোথায়, সে অনেকক্ষণ! তাও সবটা খাইনি। তোমার বন্ধুরা যা গলগল করছিল, উঠে এসে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলাম। একজন তো দেখলাম, চিনি ছড়িয়ে দিয়ে লুচি বেগুনভাজা খেল। বিনু হেসে কুটোকুটি।
তুমি বড় অসভ্য হয়ে উঠেছ! যে যেমন খায়–। বিনুর মা মেয়েকে ধমকালেন।
উনি আবার চলে যাচ্ছেন, বিনু চায়ের কথা মনে করিয়ে দিল।
কাকা এলে হবে, বিনুর মা ঘর ছেড়ে চলে গেলে।
বিনু নাক কোঁচকালকাকা এলে। পা তুলে নাচাতে গিয়ে এক পায়ের চটি খুলে গেল, যেন ছুঁড়েই দিল বিনু। বিড় বিড় করার মতন ঠোঁট কাঁপল, কিছু শোনা গেল না।
সকালে তোমার কী হয়েছিল? বিনু দুমুহূর্ত অন্যমনস্ক থেকে আবার ঠিক হয়ে গেল।
বাড়ির একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম বোধন বলল, বলে আবার কিছু মনে পড়ে গেল। এলেই বা কী হত! তোমার জ্বর।
আজ আর তেমন জ্বর কোথায়! কাল যা গিয়েছে, যত জ্বর, তত মাথা ব্যথা। গা হাত চিবিয়ে খাচ্ছিল। পটাপট ওষুধ খেয়েছি। যায় নাকি! এ হল খাঁটি ইউনিফ্লুয়েঞ্জা। জাপান থেকে এসেছে।
বোধন হেসে উঠল।
হাসছ! হাসার কী দেখলে। জাপান থেকে হংকং থেকে কত কী আসছে। কাগজ পড় না।
বোধন মাথা নাড়ল। মজা করে। বিনুকে তেমন দুর দূর মনে হয় না। সত্যি, ভাল লাগে।
আজ জ্বর কত? বোধন কথা ঘুরোতে চাইল।
আজ কম! সকালে একশো ছিল। দুপুরেও তাই। এখন জানি না।
আমার সঙ্গে কী দরকার ছিল বলছিলে? বোধন বলল।
ধ্যুত, দরকার আবার কী! সারাদিন বিছানায় শুয়ে আছি, ভাল লাগছিল না। বিবিধ ভারতী শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে গেল। গল্পর বই পড়তেও ভাল লাগছিল না–,বলেই বিনু আচমকা থামল, তারপর পরম বিস্ময়ের চোখ করে বলল, ও হরি! বলতেই ভুলে গিয়েছি। তুমি ওটা কী লিখেছিলে খাতায়? গোঁজামিল যা চালাচ্ছো!
বোধন অবাক। গোঁজামিল?
সিলিকনের অ্যাটমিক ওয়েট কত?
কেন?
টুয়েন্টি সেভেন পয়েন্ট ওয়ান নয়; টুয়েন্টি এইট পয়েন্ট থ্রি। বইয়ে আছে।
বোধন বোকার মতন তাকাল। নাকি? ভুল হয়েছিল আমার। বই ঠিক দেখেছ তো?
দেখবে তুমি?
না না, আমার দেখার দরকার নেই। তুমি তো দেখেছ! বোধন যেন ব্যাপারটা এড়াতে চাইল।
আর-একটা গোঁজামিল বলব?
বোধন অপ্রস্তুত, কুণ্ঠিত হল। রাগও হল সামান্য। বলল, দেখো, আমি কিন্তু আগেই বলেছি আমি গাধাবোট। পাস কোর্সের বি এস সি৷ কিচ্ছু জানি না। যেমন ফিজিক্স, তেমনি কেমিস্ট্রি সবেই মাস্টার।
বিনু মুঠো তুলে বুড়ো আঙুল দেখাল। আমারও তো ওই দশা হচ্ছে। পাস কোর্সে বি এস সি পড়ছি। আমারও কাঁচকলা হবে। এর চেয়ে বটানি পড়লে ভাল হত। দিস ইজ কচু, দিস ইজ মোচা বলে চালাতাম। সুষমি কি মজাসে আছে! বিনু সর্দি জড়ানো বসা গলায় হাসতে গিয়ে কাশতে লাগল।
বোধনের হাসি পাচ্ছিল না। বিনুকে পড়াবার জন্যে সে যেচে আসেনি। তেমন যোগ্যতা যে তার নেই–বাধন জানে। সাধারণ ছেলে সে, মাথা মোটা। রগড়ে রগড়ে পরীক্ষায় পাস। বন্ধুদের সঙ্গে হল্লা করে বি এস সি পড়তে ঢুকেছিল। পাস কোর্স। কোনও রকমে টপকে গিয়েছে। নিজের লেখাপড়া সম্পর্কে তার কোনও অহঙ্কার নেই। বিনুও ভাল ছাত্রী নয়, লেখাপড়াতেও তার মন নেই। এখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। শখের পড়া পড়তে ঢুকেছে। শখের পড়া বলেই শখের মাস্টার। আসলে মাস্টার নয় বিনুর হেলপার: এটা টুকে দাও, ওটা খুঁজে দেখো-এই আর কী! বোধনকে এই বাড়িতে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুকুমারদা। মাস্টারি নয়, অল্পস্বল্প দেখিয়ে দেবার জন্যে। বিনুর মা পঞ্চাশটা করে টাকা দেন মাসে। গত মাসে পেয়েছে বোধন, প্রথম। এ-মাসেও পাবে। আজ সেই টাকার জন্যে এসেছে বোধন। টাকাটা বড় দরকার। দরকার বলেই সন্ধেবেলায় আসা। নয়তো তার আসার সময় সকাল।
বোধন অন্যমনস্কভাবে বিনুর দিকে তাকাল। আগের বার বিনুর মা নিজেই ঠিক সময়ে টাকাটা দিয়েছিলেন। সাত তারিখে। তারপর পুজো পড়ল। এবারেও দেবেন এই আশা নিয়ে বোধন এসেছে। বিনুর মা তো কিছু বললেন না। ভুলে গিয়েছেন নাকি?
বিনু সামান্য চুপ করে ছিল; হঠাৎ বললে, তুমি কেন আলতু-ফালতু পড়তে গেলে! ছেলেদের পাস কোর্সে পড়ে কিছু হয় না।
আমারও কিছু হবে না, বোধন বলল; পুরোপুরি ঠাট্টা করে নয়।
বিনুর মা ডাকছিলেন।
উঠে গেল বিনু।
বোধন বুঝতে পারল না বিনুর মা কেন ডাকলেন? তিনি কি বিনুর গল্প করা পছন্দ করছেন না? গায়ে জ্বর নিয়ে এতক্ষণ বকবক করা যে বিনুর ভাল হচ্ছে না–হয়তো মেয়েকে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বা, বোধনের হঠাৎ মনে হল, বিনুর মার হয়তো টাকার কথা মনে পড়ে গিয়েছে। বিনুর হাত দিয়েও টাকা পাঠিয়ে দিতে পারেন। বোধনের একটু আশা জাগল। যদি টাকা না আনে বিনু, বোধন কি একবার মুখ ফুটে বলবে? সেটা কি ভাল দেখাবে? বিনুর জ্বর, এখন কি টাকার কথা তোলা উচিত? তা ছাড়া টাকা পয়সার ব্যাপারটা বিনুর কাছে না তুলে বিনুর মার কাছে ভোলাই উচিত।
বিনু এল। হাতে দু কাপ চা। ধরো শীঘ্রি…!
বোধন খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল, হাত বাড়িয়ে চা নিল।