এরাও কিন্তু বেশ আছে। রিকশাঅলাদের কাছ থেকে পয়সা নেয়, দোকান থেকে এটা ওটা ঝাড়ে, ছিনতাই করে তেঁতুলতলার দিকে, একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিতে পারলেই দু পয়সা। পুলিশ কত বার ধরে নিয়ে গিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে।
বোধন সুকুমারের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই গায়ের ওপর রিকশা এসে পড়ল।
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না বোধন। বউদি বাসে।
আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। বোধন বলল–কোথায় যাচ্ছ?
চাবি এনেছ। দাও। বোধন দোকানের চাবি আর টাকা দিল। যাচ্ছ কোথায়?
শ্যামাদের বাড়ি। আমার নেমন্তন্ন আছে।
ফিরবে কখন?
ক-ত আর! নটা।
আচ্ছা যাও।
রিকশা চলে গেল। বউদি যে কী মেখেছিল কে জানে, সস্তা ভারী গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।
.
বাড়ি ফিরে বোধন দেখল, মা ফেরেনি। চুয়াও বাড়ি নেই। বাবা দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলে বাবা আবার নিজের জায়গায় চলে যাচ্ছিল।
মা ফেরেনি?
না।
এতক্ষণে ফিরে আসার কথা মার। প্রায় আটটা বাজতে চলল। ফিরতে দেরি হবে বলে গেছে?
আমায় কিছু বলে যায়নি। শিবশংকর বললেন।
চুয়া?
বেরিয়েছে। শিবশংকর নিচু হয়ে মাটিতে কী যেন দেখছিলেন।
বোধন ঘরে ঢুকে অন্ধকারে প্যান্ট ছাড়ল। লুঙ্গি পরে বাথরুমে চলে গেল। ফিরে আসার সময় আবার বাবাকে দেখল। টেবিলের সামনে বাবা বসে আছে। ছোট ময়লা লণ্ঠন জ্বলছে সামনে। জানলা খোলা। বাবার সামনে আধ-ছড়ানো তাস। মাটির ভাঁড়। বিড়ি আর দেশলাই। যখন বাবার হাতে ক্রস ওয়ার্ড থাকে না বা ওইরকম কিছু–তখন বাবা তাস নিয়ে বসে পেশেন্স খেলে। মা দু চক্ষে তাস খেলা দেখতে পারে না। মা না থাকলে বাবা লুকিয়ে তাস খেলে।
বোধনের হঠাৎ মনে হল, বাবা বসে বসে পেশেন্স খেলছিল, তারপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে প্রথমে ভেবেছিল মা, মা ভেবে ভয় পেয়ে তাস গুটোতে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলেছে কয়েকটা। অথচ পরেই বাবা বুঝতে পেরেছিল মা নয়। সিঁড়িতে মার পায়ের শব্দ হলে বাবা বুঝতে পারে, আর কড়া নাড়ার শব্দ বুঝবে না! আসলে ভুল হয়ে গিয়েছিল বাবার।
বাবার এই ছেলেমানুষিতে বোধনের হাসি পেল, মায়াও হল। মেঝেতে পড়ে থাকা বাকি কটা তাস তুলে দিতে দিতে বলল, মার এত দেরি হচ্ছে কেন?
আটকে পড়েছে কোথাও। কলকাতার যা হালচাল।
হয়তো মিছিল বেরিয়েছে। …তুমি বিকেলে চা খেয়েছ?
জবা করে দিয়েছিল।
কেন, চুয়া?
চুয়া বিকেলের আগেই চলে গিয়েছে।
চুয়ার আজ নিশ্চয় কোনও থিয়েটার আছে। অফিস ক্লাবে। এই পাড়ারই কে একজন সেদিন বলছিল, তাদের অফিসের থিয়েটারে চুয়াকে পার্ট করতে দেখেছে। আরে, বোধন তোমার বোন কি অ্যামেচার প্লে করে! স্টেজে দেখে তাই মনে হচ্ছিল। তবে রংচং মেখে ড্রেস পরে নেমেছিল তো! চিনতে পারছিলাম না। প্রোগ্রামে আবার নাম লেখা অর্চনা। …তা ভালই করেছে। স্টেজ ফ্রি।
চুয়ার ভাল নাম অর্চনা।
বোধন হঠাৎ বলল, চা খাবে?
চা? তুই করবি?
করি। আমার জ্বরজ্বর লাগছে। এ-পি-সি খেয়ে গরম চা খাব। আলোটা একবার নিচ্ছি। বোধন রান্নাঘরে ঢোকার আগে লণ্ঠনটা তুলে নিল। কুপি জ্বালিয়ে নিয়ে আবার এসে রেখে দিল টেবিলে। রান্নাঘরে চলে গেল।
কেরোসিন স্টোভে চায়ের জল চড়িয়ে দিয়ে বোধন বাইরে আসতেই কড়া নড়ে উঠল। মা এসেছে। মা জোরে জোরে কড়া নাড়ে। থামে না। বেশ বোঝা যায় মা অধৈর্য।
বোধন বাবার দিকে তাকাল। শিবশংকর তাস লুকিয়ে ফেললেন।
দরজা খুলে দিল বোধন।
সুমতির পায়ে যেন জোর নেই, দম ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনও রকমে চটি ছেড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে পড়লেন। ছেঁড়াখোঁড়া ময়লা চামড়ার ব্যাগটা ফেলে দিলেন টেবিলের ওপর। পায়ের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিলেন। ক্লান্ত, রুক্ষ, অবসন্ন চেহারা। ঘাম জমেছে মুখে। হাঁ করে শ্বাস টানছিলেন।
বোধন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তোমার এত দেরি? জিজ্ঞেস করল না। মা আগে দম নিয়ে সামলে নিক।
সুমতি জল চাইলেন মেয়েকে ডেকে।
চুয়া নেই। বলে শিবশংকর বোধনের দিকে তাকালেন। বোধন জল আনছিল।
কোথায় গিয়েছে ও? সুমতি স্বামীর দিকে তাকালেন।
আজ বোধ হয় হাতিবাগান।
বোধ হয় কী! ঠিক করে বলতে পারো না! সব কথায় বোধ হয়।
শিবশংকর চুপ করে থাকলেন। যে-মানুষটা এইমাত্র বাড়ি ঢুকল তাকে চটাতে চান না।
বোধন জল এনে দিল।
সুমতি ছেলেকে দেখলেন। আগে খেয়াল হয়নি হয়তো, এখন হল। জল খেয়ে হাঁফ ফেললেন। তুমি আজ বাড়িতে যে?
বোধন জবাব দিল না। এ সময় বাড়িতে থাকাটা যেন তার মস্ত অপরাধ হয়ে গিয়েছে।
সুমতি আঁচলে মুখ মুছে একটু হাওয়া খেতে লাগলেন। বোধন রান্নাঘরে চলে গেল।
শিবশংকর নিচু গলায় বললেন, আজ বাসের গণ্ডগোল ছিল?
কোন দিন না থাকে! ছ্যাঁচড়ামির শেষ নেই। যেমন স্টেট তেমনি প্রাইভেট।
এই জায়গাটাও দূর…!
সুমতি কান করলেন না। রান্নাঘরে ও কী করছে?
চা। ওর জ্বর জ্বর লাগছে। চা দিয়ে ওষুধ খাবে।
সুমতি বড় করে শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। আজ ঘটকবাবু এসেছিলেন দোকানে।
শিবশংকর গলা পরিষ্কারের শব্দ করলেন। ঘটক? কেন?
মেয়ের বিয়ে। কটা ভাল শাড়ি কিনতে এসেছিলেন। আঠাশে অঘ্রানে বিয়ে।
কেমন আছে সব?
ভাল। আরও গোলগাল দেখতে হয়েছেন। মাথার চুল পেকেছে। শরীর ভাঙেনি।
ঘটক আমার চেয়ে দু বছরের ছোট ছিল।
তোমার কথা বাদ দাও। তুমি ছোট থাকলেই বা কী হত, আর বড় হয়েই বা কী হয়েছে। দেখলাম তো, কেমন সুখেশান্তিতে আছে। মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। সবাই মিলে ব্যাঙ্ক থেকে জমি কিনেছে তারাতলায়। বাড়ির কাজ বলল অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এখনও চার পাঁচ বছর চাকরি বাকি। সুমতির গলা কেমন ক্ষোভে দুঃখে কাতর হতাশ শোনাচ্ছিল।