মা তোমায় না সেদিন বলছিল ভাল শালকরের কাছে দুটো শাল দিয়ে আসতে? বিনু বলল।
হ্যাঁ। দিয়ে দিয়েছি তো?
বড় কাঁচিটাও ধার করিয়ে এনে দিয়েছ?
তাও দিয়েছে বোধন। কিন্তু এসব কথা আসছে কেন? এটা ঠিক, বিনুর মা আগে যেমন বোধনকে কুনজরে দেখতেন না তেমন খুব সুনজরেও নয়। নিস্পৃহ ভাব ছিল। এখন সেটা নেই। বিনুর মা তাকে আজকাল স্নেহই করছেন। দু একটা সাংসারিক কাজকর্মের কথা বলেন। বোধন করে দেয়।
বিনু হঠাৎ বলল, মার এই ফিটের ব্যারামটা কবে থেকে, জান?
বলেছ তো, পুরনো।
পুরনো মানে কত পুরনো জান না তো?
না, কেমন করে জানব।
বিনু কিছু ভাবল। পরে একদিন বলব।
কথা পালটাবার জন্যে বোধন বলল, মাসিমাকে বলেছি, কাকাবাবুকে বলে আমায় একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে।
জানি।
তোমার কী মনে হয়? কাকাবাবু চেষ্টা করলে নিশ্চয় হবে।
বিনু ঘাড় হেলাল। হবে বই কী!
বোধন খুশি হল। তুমি একটু তাগাদা মেরো না, প্লিজ।
বিনু হাসল না। লেখার ওপর থেকে হাত সরাল। তারপর কাগজটা এগিয়ে দিল বোধনের দিকে।
বোধন দেখল, বিনু জড়িয়ে জড়িয়ে লিখেছে: আই ডু নট লাইক মাই মাদার।
.
০৭.
জগৎ অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল। দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে চায়। আবার একবার তাগাদা দিল বোধনকে।
বোধন বলল, কী করবি বাড়ি গিয়ে? এমনিই বলল, কিছু না ভেবেই।
ঘুমিয়ে লেব। আজ আমার লাইট গার্ডের ডিউটি আছে। জগৎ এই রকমই। ন তার মুখে কমই আসে, সবই ল সুকুমারদা মাঝেমাঝে জগৎকে খেপায়: এই জগা, ধর তুই বিয়ে করলি–তোর বউয়ের নাম নিভারানী। তখন তুই কী করবি? জগৎ বলবে না; সুকুমারদাও ছাড়বে না। শেষে সুকুমারদা জগৎকে মাস্টারের মতন ন-এর উচ্চারণ শেখাবে: নবাব নন্দন, নিত্য নব নর্তকী নাচাইয়া আছ খাশা! বল শালা। তারপর যতরকম হাসি মশকরা।
বোধন বলল, নে তবে–দোকান বন্ধ কর। বোধনেরও শরীর ভাল লাগছিল না। মাথা ধরে আছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে। ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। দেখতে দেখতে শীতও আসছে।
জগৎ দোকান বন্ধ করতে লাগল।
সুকুমারদা দিন দুই হল কলকাতায় নেই। বর্ধমানে গিয়েছে। বর্ধমান শহর থেকে খানিকটা তফাতে সুকুমারদাদের বাড়ি। পাকা বাড়ি। তার কতটুকু বাসযোগ্য আছে কে জানে। সুকুমারদার মা আর কিছুতেই ছেলেবউয়ের কাছে থাকবে না। বউ বজ্জাত, বউ সহবত জানে না, বউ শুধু সাজন-গোজন আর সিনেমা শিখেছে।
রোজ বাড়িতে অশান্তি, খিচির-মিচির, মা বলে তুই আমার বেটা হয়ে থাক। বউ বলে তুমি আমার স্বামী না, তবে? ধুর শালা, সুকুমার অত ঝাটে নেই। বেশ চলো তুমি বর্ধমানে, জ্ঞাতিগোষ্ঠী তো আছে, তা ছাড়া না না করেও দু-চার বিঘে জমি। চলো তোমায় বর্ধমানেই রেখে আসি, অতই যখন তোমার ইচ্ছে।
বর্ধমানের বাড়িতে মায়ের থাকার ব্যবস্থা সেরে সুকুমারদা ফিরবে। বোধনকে দোকান দেখাশোনা করতে বলে গিয়েছে। কাল পরশু নাগাদ ফিরে আসবে সুকুমারদা।
জগৎ দোকান বন্ধ করে চাবি দিল বোধনকে। বোধন চাবি আর খুচরো বিক্রির বাইশ তেইশটা টাকা সুকুমারদার বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কাল দোকান খোলার সময় জগৎ গিয়ে চাবি আনবে।
জগৎ চলে গেল। বোধনও আর দাঁড়াল না। নাক গলা জ্বলে যাচ্ছে। মাথা ভার। কপাল যেন ছিঁড়ে পড়ছে। দুটো বড়ি না খেলেই আর নয়। সকালে চারটে কিনেছিল, দুটো খেয়েছে।
রোজই যেমন হয় আজও সেইরকম হল। অন্ধকার হয়ে গেল ঝপ করে। মধ্যে কদিন এই সময়টায় আলো থাকছিল, যাচ্ছিল রাত্রের দিকে–দশটার পর। আবার পুরনো খেলা শুরু করেছে।
সুকুমারের বাড়ি দূর নয়। মিনিট আট দশের রাস্তা। অন্ধকার দিয়ে গলি দিয়ে হাঁটছিল বোধন।
যেতে যেতে একটা হাসি-হুঁল্লোড় শুনল। তাকাল বোধন। দুধের ডিপো আর বটোর কয়লার দোকানের পাশে একফালি জমির ওপর যে বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে জনাচারেক ছেলে বসে। দিশি মদের গন্ধ আসছে যেন। বোধন বুঝতে পারল, কচার দল। কচা সকালে পাড়ার রিকশাঅলাদের ইউনিয়ন করে, সেলফ মেড নেতা। ভোটে মস্তানি করার পর থেকে কচার স্ট্যাটাস হয়েছে। রিকশা-নেতা কচা তার রেট বেঁধে দিয়েছে: রিকশা প্রতি রোজ পঁচিশ পয়সা। রিকশা ইউনিয়ন করে করে কচার লোভ বেড়ে গিয়ে সে বাজারের সবজি এবং মাছঅলাদের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েছিল সেখানে জোর ধাক্কা খেল, গোপাল আরও বড় কর্মী, কচাকে বেদম মারল। দুটো পটকা ফাটিয়ে কচা আবার যেমন কে তেমন।
এক সময় বোধন এদের ভয় করত। এখন করে না। কারণ, এরা পাড়ার লোকের প্রত্যেকের গা শুঁকে জেনে নিয়েছে, কার কত দুর দৌড়? বোধনের পেছনে সুকুমারদা আছে, কাজেই সে নিশ্চিন্ত।
কচারা বোধনকে দেখতে পেল কি না কে জানে, কিছু বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে নিচু গলায়– তারপর শেয়ালের ডাকের মতন তিন চারটে গলা কেয়া হুয়া গাইতে লাগল।
বোধন তাকাল না। কচারা বোধনেরই সমবয়েসী। পাড়ার ছেলে। তবু বোধন কোনওদিনই ওদের সঙ্গে মেলামেশা করেনি। ভাল লাগে না। বোধনরা যখন মানিকতলা থেকে এখানে প্রথম এল তখন কচা স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে চায়ের দোকানে বসে বসে রকবাজি করে। তার সাকরেদ ছিল বস্তির কটা চ্যাংড়া। বোধনকে নতুন পেয়ে কচা পেছনে লেগেছিল। খিস্তি করত। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াও বাধাল একদিন, ঘঁষোঘঁষি খামচাখামচি হল দুজনে, তারপর মনুয়া কোত্থেকে উড়ে এসে দু-চারটে লাথি কষাতেই সব শান্ত। বোধন তখন থেকেই ওই লোফার লোচ্চাটাকে ঘেন্না করে।