বাসের মধ্যে এত কথাবার্তা ভাল লাগছিল না বোধনের। সবাই শুনছে। নিজেদের ব্যাপার দশজনের সামনে চেঁচিয়ে বলার কী আছে! বোধন জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
আরও তিন চার স্টপ এগিয়ে ছেলেটি নেমে গেল। চলি। এখানে একটা কাজ সেরে ফিরব।
পরের স্টপে বোধন জানলার দিকে জায়গা পেল। কোথায় এল বাস সে জানে না। তবে এখনও ট্রাম দেখা যাচ্ছে না।
ছেলেটিকে আবার মনে পড়ল বোধনের। কলেজে নিশ্চয় পড়ত তাদের সঙ্গে। নাম যে কী বোধনের মনে এল না। হয়তো ছেলেটিও নাম ভুলে গেছে বোধনের। এই রকমই হয়। বোধন তার ছেলেবেলার সব বন্ধুর কথা মনে রাখতে পারেনি, মানিকতলার অনেকের কথা তার একবারও মনে পড়ে না। দু-চার জনের কথা নিশ্চয় পড়ে। যেমন হারীত। হারীতের বাড়িতে এখনও দু-এক মাস অন্তর যায় সে। বড় ভাল ছেলে। হরীত বায়ো-কেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছে। দু বছরের স্কলারশিপ পেয়েছে হারীত।
এই হারীত সেদিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল। সে নাকি বোধনের দিদিকে একদিন এসপ্ল্যানেডে দেখেছে। সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। ট্রাম ধরার জন্যে দাঁড়িয়েছিল।
অন্য কেউ বললে বোধন বিশ্বাস করত না। হরীত বলেছিল বলেই সে বিশ্বাস করেছিল। একটু সন্দেহ তখনও ছিল, আজও আছে। কথাটা বাড়িতে কাউকে বলেনি বোধন। বলে লাভ কী! দিদিকে সবাই ভুলে গিয়েছে। মা, বাবা, চুয়া। দিদির কথা কেউ বলে না। মা কখনও নয়। বাবার মুখ থেকে কথাই শোনা যায় না তো কী বলবে! আর চুয়া? সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে মার মুখের ভয়ে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে, নয়তো সে নিজের মতন। বাড়ির ওপর তার বিরক্তি, ঘেন্না বোঝা যায়। চোখের ওপর দেখতে দেখতে কেমন পালটে গেল। রোজই বাড়ির বাইরে যায়। কোথায় ঘোরে কে জানে,বলে গানের টিউশনি করে, থিয়েটারে রিহার্সাল দেয়। মা তেমন কিছু বলে না, এক-আধ দিন গালাগালি দেয় অবশ্য, কিন্তু অত বড় মেয়েকে মা আর কী বলবে! যাকে কিছুই দিতে পারে না মা–একটা ভাল শাড়ি না, জামা না, জুতো না, না পারে মেয়েকে আলাদা করে এক শিশি শ্যাম্পু কিনে দিতে। তাকে মা কোন লজ্জায় বলবে, না, তুমি বাড়িতে বসে থাকো। চুয়া যা করছে তাতে তার হাতে কিছু অন্তত আসে। তাতে চুয়ার নিজের দরকার সামান্য মেটে। আর দায়ে-অদায়ে মা নিজেও তো দু-চার টাকা চায়।
হারীত বলছিল, দিদি গোলগাল হয়েছে। ছেলেটাও দেখতে ভাল। বদ্যিনাথের রং ছিল কুচকুচে কালো। কিন্তু চোখা চেহারা ছিল। দিদির ছেলের চেহারা ভাল হতেই পারে। তবে বেটা নিশ্চয় কালো হবে। বোধনের হাসি পেল, আবার কষ্টও হল। দিদিকে একবার কি সে দেখতে পায় না? কত সময় কত পুরনো লোকের সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়, যেমন আজই হল। দিদির সঙ্গে বোধনের যদি এইরকম দেখা হয়ে যেত!
আচ্ছা, দিদিই বা এমন নিষ্ঠুর কেন? সে কেন মা বাবাকে চিঠি লেখে না। কেন আসে না একবার? এলে কি মা তাকে তাড়িয়ে দেবে? দিদি কোনও খোঁজই করে না নিজের মা বাবা-ভাই-বোনের। দিদি মা বাবার খোঁজ করতে পারত। পুরনো কথা এতকাল কেউ মনে করে রাখবে না। মার অফিসের কথা দিদি জানে, দিদি অন্তত মার অফিসের ঠিকানায় চিঠি দিয়ে খবর নিতে পারত। সে নেয় না। হয়তো ভুলে যেতে চায়, ভুলেই গিয়েছে।
মেয়েরা মাকে কি তেমন ভালবাসতে পারে না? বিনুর বেলাতেও তাই দেখছে বোধন। আগে অত বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারছে, বিনু তার মার ওপর তলায় তলায় খুশি নয়। মুখে সে হুট করে কিছু বলে না, কিন্তু ভেতরে বোঝা যায়।
কদিন আগে বিনু তাকে মুশকিলে ফেলেছিল। কী কথায় ফট করে বলল, মা তোমাকে ডিউটি দেয়নি?
ডিউটি কীসের?
কাকা থাকবে না, কানপুর যাচ্ছে। মাকে কদিন গার্ড দিতে বলেনি?
বোধন থতমত খেয়ে গেল। তার মানে?
বাঃ, মা এখন তোমার ওপর দারুণ খুশি। সেদিন যা উপকার করেছ মার। তুমি না থাকলে ফিট হয়ে মরে পড়ে থাকত!
কথাটা ঠিক না; আবার একেবারে মিথ্যেও নয়। যদি এমন হত, বিনুর মা মোমবাতি ধরিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে যেতেন তবে কাপড়-চোপড়ে নির্ঘাত আগুন লেগে যেত। বাড়িতেও তো তখন কারুর থাকার কথা ছিল না।
ফিটে কেউ মরে না। তবে কাপড়ে-চোপড়ে আগুন লেগে গেলে বিপদ হত। ওই জন্যে বলে, ফিটের রুগির ভয় জলে আর আগুনে।
ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল বিনু। তারপর বলল, তা বাবা, এখন তুমি মার বেশ পেটোয়া হয়েছ। তোমার ওপর কত কী বলব-দাঁড়াও, হ্যাঁ কনফিডেন্স।
বোধন হাসল।
হাসছ? বিনু যেন বিরক্ত।
হাসব না তো কী করব! আমার ওপর কারও কোনও কনফিডেন্স নেই।
বিনু আড়চোখে দেখল বোধনকে। তারপর খাতার ওপর ডট পেন দিয়ে কিছু লিখল, হাত আড়াল করেই। বোধন দেখল না। পড়া থামিয়ে গল্প করছিল বিনু, আবার কিছু লিখে নিচ্ছে ভেবে বোধন মনে মনে সেদিনের কথাটা ভাবতে লাগল। বিনুর মা মেঝেতে পড়ে আছেন, পায়ের দিকের কাপড় অগোছালো, হাত মুঠো, পায়ের পাতা বাঁকা, দাঁতে দাঁত লেগে রয়েছে–এই দৃশ্যটা সে ভুলতে পারে না। আবার ওরই সঙ্গে সে ভুলতে পারে না, বিনুর মার বুকে কাপড় নেই কোথাও, আধ-খোলা জামা ঘামে-জলে ভিজে নীচের জামা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গলার তলার দিকের বুক দেখা যাচ্ছে। বোধন সেদিন থেকে কতবার যে এই দৃশ্যটা মনে মনে দেখেছে। কেন? বিনুর মা বয়েস হলেও সুন্দর বলে?