ঘামে জামা জবজবে হয়ে গেল।
বোধন বাতাস করতে লাগল কাগজ দিয়ে।
আরও একটু পরে বিনুর মা চোখ খুললেন। তাকালেন। যেন হুশ করতে লাগলেন। মাথা ফেরালেন। দেখলেন। ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিলেন।
এবার সব খেয়াল হল অনুপমার। বোধনকে দেখলেন। ওরা ফিরেছে?
না।
লোডশেডিং।
হ্যাঁ। অনুপমার উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছিল। পারছিলেন না। তবু উঠে বসলেন সামান্য। দেখলেন যেন নিজেকে। তারপর খুব মৃদু ক্লান্ত গলায় বললেন, তুমি ও-ঘরে গিয়ে বসো৷বলতে বলতে মাটি থেকে আঁচল উঠিয়ে বুকের কাছটা আড়াল করলেন।
২. কলকাতার কাছাকাছি
০৬.
কলকাতার কাছাকাছি কত কী থাকে! বোধন দু-চারবার যে টেঙরায়, গরচা রোডে, গড়িয়ায় যায়নি তা নয় তবে জায়গাগুলো তার কাছে তেমন চেনা নয়। আজ বোধন গিয়েছিল বেহালার দিকে। বঁড়শে-টঁড়শে পেরিয়ে। একটা কেমিক্যাল কারখানায় লোক নেবে বলে কাগজে বেরিয়েছিল কবে তাও বোধন জানে না। দুম করে একটা চিঠি পেল বোধন। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে। বোধন কাউকে কিছু বলেনি, সকালে মা অফিস বেরোবার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। গিয়ে পৌঁছতেই ঘণ্টা দুইয়ের কাছাকাছি। তবে যাওয়াই সার। কারখানা নতুন। বছর দুয়েকের। নামেই কেমিক্যাল, আসলে ব্লিচিং পাউডার, মেঝে পরিষ্কারের লিকুইড সোপ, গুঁড়ো সাবান, লেখার সস্তা কালি, কারবলিক অ্যাসিড এই সব তৈরি করে। বোধনকে দাঁড়াতে হয়েছিল ঘণ্টা দেড়েক। তারপর যা হয়, একবার ডাকল, মুখ দেখল, দু চারটে ফালতু কথা; শেষে পরে জানিয়ে দেব।
বোধন কাছাকাছি একটা দোকান খুঁজে কিছু খেতে ঢুকল। টিনের চালার দোকান। হাতে-গড়া রুটি, আলুর দম, পাউরুটি, ডিমের ওমলেট, চা পাওয়া যায়। হাতে-গড়া রুটি আলুর দম খেয়ে বোধন নাক চোখ মুছতে লাগল। কী ঝাল রে, বাবা। বাসি সোনপাপড়ি ছিল, তাই একটা মুখে দিয়ে সামলাল নিজেকে। চা খেল। তারপর বড়লোকি মেজাজে পাশের দোকান থেকে পান মুখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
এখানে-ওখানে নানান গাছ, মাঝেমাঝে জংলা ঝোপ। গাছের ছায়ায় পাথরের ওপর বসে বোধন কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছিল। সিগারেট শেষ করে উঠবে। বাস ধরতে মিনিট আট দশ হাঁটতে হবে তাকে। বোধন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এসব জায়গা এখনও পুরো শহর হয়নি। আধা শহর হয়েছে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। পুকুর, ভাঙা মন্দির, বেলগাছ, নিমগাছ আরও কতরকম কী চোখে পড়ে। রোদও চড়া নয়, তাত নরম, আকাশ নীল। একটু হাওয়া দিচ্ছিল। আরাম লাগছিল বোধনের। অলসভাবে সিগারেটটা শেষ করতে লাগল।
সাইকেলে কে একজন আসছিল। খাটো ধুতি, গায়ে জামা, কোমরের কাছে গামছা বাঁধা। লোকটা যেতে যেতে বোধনকে দেখল। চলেই যাচ্ছিল। থামল হঠাৎ। নেমে পড়ল। ফিরে এল বোধনের কাছে।
দেখল বোধনকে। নিতাই নাকি?
বোধন অবাক। লোকটাকে দেখছিল। মাথা নাড়ল।
নাম কী?
নাম বলল বোধন।
এখানে আসা হয়েছিল কেন?
চাকরির কথা বলল বোধন।
লোকটা বলল, নিতাই, নিতাই মনে লাগল। জামাইয়ের ছোট ভাই। থানা থেকে শালাকে হুলিয়া করেছে। ভাবলাম হারামজাদা ফেরারি হয়ে বসে আছে এখানে। চলি!
লোকটা আবার সাইকেলে চেপে চলে গেল। বোধন অনেকক্ষণ লোকটাকে দেখল। নির্ঘাত পাগল।
বোধন উঠে পড়ল। বাস ধরতে হবে।
ঝোপঝাড়, গাছপালা, কখনও রোদ কখনও ছায়া দিয়ে আসতে আসতে বাতাসের দমকা গায়ে লাগার পর বোধন হঠাৎ অনুভব করল, কোথায় যেন শীতের গন্ধ লেগেছে। মাথার ওপর আকাশে অনেক উঁচুতে চিল উড়ছে, কাছাকাছি মেঘ নেই, রোদের রং অন্যরকম, কুলগাছের তলায় জোড়া শালিখ, নয়নতারার জঙ্গলে কত না প্রজাপতি।
বোধনের হঠাৎ মনে পড়ল নভেম্বর মাসের আজ তিরিশ হয়ে গেল। কাল বাদ দিয়ে পরশু বিনুর কাকার ফিরে আসার কথা। অফিসের কাজে বিনুর কাকা বাইরে গিয়েছেন। ফিরে এসে বোধনকে নিজের কলকাতার অফিসে নিয়ে যাবেন। একটা চাকরি হয়ে যেতে পারে! কথাবার্তা বলা আছে।
.
বাস রাস্তায় পৌঁছে বোধন দাঁড়াল।
জায়গা ছিল। বোধন বসতে পারল।
হাই উঠছিল। জানলা ঘেঁষে বসতে পারলে হয়তো চোখ বুজে ঘুম দিত। বোধন বাসের লোকজন কণ্ডাক্টরকে দেখছিল। টিকিট করাও হয়ে গেল।
আরে–এই–এই যে!
বোধন তাকাল। চেনাচেনা লাগল। তারই বয়েসী ছেলে হাত তুলে নিজেকে চেনাচ্ছে।
কী খবর? বোধন বলল।
এই তো। তোমার?
আমারও সেই রকম। এদিকে কোথায়?
একটা কাজে এসেছিলাম।
যাক তবু তোমরা কাজে আস। আমি ভাই অকাজে ঘুরে বেড়াই। কী করছ?
তেমন কিছুই না, বোধন বলল, এই সামান্য কিছু। আসলে বাসের মধ্যে চেঁচিয়ে কিছুই করছি না বলতে লজ্জা করল বোধনের। তা ছাড়া ছেলেটাকে মুখচেনা লাগলেও তার নাম, কিংবা ও যে কে তা মনে করতে পারছিল না! তুমি কী করছ?
পোলট্রি, ডেয়ারি, ফিশারি যা পারছি। এদিকে আমাদের এক মহাজন থাকে; মানি ম্যাটার্স…। তার কাছে এসেছিলাম। লেগে আছি, ভাই। পেটটা চলে যাচ্ছে। ফ্যামিলি বার্ডেন কম–তাই টিকে আছি। নয়তো মরে যেতাম। তোমার আর সব খবর ভাল?
চলছে। আজকাল আর কে ভাল থাকে!
একটু থেমে ছেলেটি আবার বলল, জয়ন্তর খবর শুনেছ?
জয়ন্তর নাম মনে পড়ল বোধনের। কলেজে একই সঙ্গে পড়ত। এই ছেলেটিও তা হলে কলেজের একজন হবে।
জয়ন্ত কানাডা চলে গিয়েছে। লেগে থেকে থেকে বাগিয়ে ফেলল ঠিক। ওর এক দিদিও আছে কানাডায়। জয়ন্ত লাকি, ভাই। তুমি ওরকম একটা চেষ্টা করলে পারতে। নাইজেরিয়া সোমালিল্যান্ড কোথাও হয়ে যেত। আমি একটা লাগিয়ে রেখেছি। যদি চান্স পাই কেটে পড়ব। দূর, এখানে, ঘোড়ার ঘাস কেটে কী লাভ!