দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে লণ্ঠন খুঁজল। পেল না। বাইরে আসতেই দেরাজের মাথায় লণ্ঠন দেখল। পর পর দুটো লণ্ঠন। ছোট মোমদানে একটা মোমবাতি।
বোধন মোমবাতি জ্বালিয়ে নিল। সদরের দরজা বন্ধ। বিনুর মার ঘরের দরজা খোলা। বিনুর ঘরে ঢুকল বোধন, কেউ নেই।
বেরিয়ে এসে বিনুর মার ঘরে ঢুকতেই বোধনের হাত থেকে মোমবাতি পড়ে যাচ্ছিল। বিছানার পাশে মেঝেতে আড়াআড়ি হয়ে পড়ে আছেন বিনুর মা। বোধনের বুক ধক করে লাফিয়ে উঠল, ভয়ে পা কাঁপছিল, কাঠ হয়ে গেল সর্বাঙ্গ। কী সর্বনাশ! বিনুর মা কি মারা গেলেন?
বোধনের হাত পা ঠাণ্ডা, অসাড়। বুকে নিঃশ্বাস আটকে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। অসহায়, ভীত, বিভ্রান্ত অবস্থা বোধনের। মোমবাতি হাতে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল বোধন। দেখল। না, মারা যাননি।
এবার বোধন মোমবাতি পাশে রেখে বসল। বিনুর মার শরীর কেমন বেঁকে আছে, পায়ের পাতাও বাঁকা, হাত মুঠো করা, চোখ বন্ধ, দাঁত দাঁত লেগে রয়েছে। ঠোঁটের তলায় ফেনা। থুতু উঠছিল। শুকিয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন বিনুর মা। মৃগী বোধ হয়, ফিটের ব্যারাম। বোধন তার পিসিকে ফিট হতে দেখেছে।
যাক, মানুষটা বেঁচে আছে। কী ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিলেন বিনুর মা।
আলো রেখে দিয়েই বোধন উঠল। জল এনে চোখেমুখে ঝাঁপটা দিলেই হুঁশ ফিরে আসবে। ধোঁয়া নাকে লাগালেও আসে। পিসির বেলায় তারা ব্লটিং পেপার পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরত। ধোঁয়া লাগলেই পিসি নড়েচড়ে উঠত।
বাইরে এসে বোধন দেরাজের মাথার ওপর রাখা লণ্ঠনটা এবার জ্বেলে নিল। আলোয় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল রান্নাঘর।
জল নিয়ে বোধন আবার ঘরে এল। লণ্ঠনও এনেছে। বিনুর মা এখন আর বেঁকে বা কুঁকড়ে যাচ্ছেন না। শরীরটা আগেই ধনুকের মতন যা বেঁকে গিয়েছিল খানিকটা। চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিল বোধন। কপালে জল দিল। কপালে, মুখে, গলায়। জোরে জোরে ঝাঁপটা দিতে লাগল। হাতের মুঠো ভীষণ শক্ত। বোধন জানে দাঁতে দাঁত লাগা খুলতে হলে জোরে গাল টিপতে হবে, না হয় চামচ এনে মুখ হাঁ করাতে হবে। হাতের মুঠোও জোর করে খুলে আঙুলগুলো টেনে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। পায়ের পাতা ম্যাসেজ করলে ওই শক্ত বাঁকানো ভাবটাও চলে যায়। কিন্তু বোধন বিনুর মাকে এ-সব কিছু করতে পারে না। সে চোখেমুখে জল দিয়ে খানিকটা বাতাস করতে পারে।
বোধন সেরকমই করছিল। কাগজ খুঁজে এনে বাতাস করছিল, ঝাঁপটা মেরে মাঝেমাঝে জল দিচ্ছিল চোখেমুখে। থেমে থেমে ডাকছিল, মাসিমা-মাসিমা।
বিনুর মা শেষ পর্যন্ত চোখের পাতা খুললেন। সামান্য। আবার বুজলেন। খানিক পরে তাকালেন দু মুহূর্তের জন্য। চোখ ফাঁকা, কিছুই হুঁশ করতে পারছেন না। শুধু যন্ত্রণার ভাব ফুটল।
মাসিমা?
কোনও সাড়া নেই।
মাসিমা–! কী হয়েছিল?
বিনুর মা চোখের পাতা খুললেন না। বাঁ হাতটা টেনে গলা বুকের কাছে আনলেন। কাপড় সরিয়ে দেবার ইশারা করলেন যেন।
বোধন আড়ষ্ট হয়ে গেল। বিনুরা কেন এখনও আসছে না? চোখ সরিয়ে নিল বোধন। এদিক-ওদিক তাকাল। মেঝেতে দশ টাকার নোট ছড়িয়ে আছে, আলনার পায়ার কাছে চাবির গোছা। বোধন বুঝতে পারল, ওটাই আলমারির চাবি। তার ধারণা হল, বিনুর মা ঘরে এসে বোধনের জন্যে পঞ্চাশটা টাকা খুঁজে নিয়ে চলে যাবার সময় হঠাৎ ফিট হয়ে পড়েন। আর তখনই আলো চলে যায়। উনি কোনও সাড়াশব্দ করতে পারেননি। শুধু কোনও রকমে মেঝেয় শুয়ে পড়েছিলেন।
এই ভাবে চাবি হারানো উচিত নয়। কিংবা বিনুর মার মতন মৃগী রোগীর বাড়িতে একা থাকাও অনুচিত। ধরো যদি অন্য কেউ হত, যেমন গোপেন কিংবা দুলু–তা হলে আজ কী হত বিনুর মার? আলমারি সাফ হয়ে যেত। টাকাপয়সা, সোনা-দানা সব। বোধনও ইচ্ছে করলে নিয়ে নিতে পারে যা খুশি। বিনুর মার কোনও হুঁশ নেই এখনও।
বিনুর মা গলায় কেমন কষ্টের শব্দ করলেন। তাকাল বোধন।
গলা আটকে গিয়েছে। বোধ হয় জল খেতে চাইছেন।
বোধন উঠল। ওঠার সময়েই ভেবে নিল, একটা চামচও আনবে।
গ্লাসে জল এনে বোধন দেখল, বিনুর মা হাতের মুঠো আলগা করতে পেরেছেন। তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি ঘোলাটে।
মাসিমা, জল?
দাঁতে দাঁত লেগে আছে তখনও। চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইলেন। বোধন বুঝল না। চামচে করে মুখে ঠোঁটে জল দিল। শেষে চামচটা দাঁতের ফাঁকে গলাবার চেষ্টা করল, পারল না।
কিছুক্ষণ পরে বিনুর মার দাঁত খুলল। জল খেলেন চামচে করে।
বুকের কাপড় খুলে ফেললেন অনুপমা। যেন সহ্য করতে পারছেন না। মেঝেতে পুঁটলির মতো পড়ে থাকল আঁচল। গলগল করে ঘামছেন। মিহি জামাটা ঘামে ভিজে গিয়েছে। কিছু জলও পড়েছে গালমুখ গড়িয়ে জামায়। শ্বাস নিচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। কষ্ট হচ্ছে কোথাও। বুকে। জামার ওপরটা খুলে ফেললেন। নিজেই। নীচের জামার খানিকটা, বুকের ওপর দেখা যাচ্ছিল।
অনুপমার মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছিল। নীলচে দেখাচ্ছে যেন।
বোধন যে কী করবে বুঝতে পারছিল না। অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তার লজ্জা করছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল।
হঠাৎ চোখে পড়ল বোধনের বিনুর মার বোজা চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। গাল নাক সামান্য কুঁচকে উঠেছিল, ঠোঁট কাঁপছিল–তারপর আর কিছু কাঁপল না, শুধু জল গড়াতে লাগল।
বোধন তার পিসিকেও কাঁদতে দেখেছে। তবে পিসি ফিট ছেড়ে যাবার পর হুশ ফিরে পেয়ে কাঁদত। বিনুর মার জ্ঞান এখনও পুরোপুরি ফিরেছে বলে তার মনে হচ্ছিল না। এখনও ঘামছেন।