একেই বলে কপাল। বোম টাকা পাবে, চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। বিনুর মা চাবি না পাওয়া পর্যন্ত বোধনকে বসে থাকতে হবে। আর যদি বরাত ভাল হয় বোধনের বিনুর মা টাকা এমনিতেই পেয়ে যাবেন।
ধীরে সুস্থে অলসভাবে চা খাচ্ছিলেন বিনুর মা। বোধন তাঁকে দেখছিল বার বার। আজও তাঁর পরনে কালকের সেই কালো পাড় শাড়ি, জমি ধবধব করছে। গায়ে মিহি সাদা জামা। আজকের জামার হাত ছোট। গলায় হার। হাতে দুগাছা করে সরু চুড়ি। সাজগোজ যেমন থাকে তেমনই তবে মুখ একটু শুকনো দেখাচ্ছিল। মেয়ের চিন্তায় বোধ হয়। তবু বোধনের ভাল লাগছিল। আজ বিনুর মাকে বেশি ভাল লাগছে। উনি কখনও এত বেশি কথা বলেন না, এতটা ঘনিষ্ঠ ব্যবহারও করেন না। আজ করছেন। বোধ হয়, বোধনকে বসিয়ে রাখতে চান বলে। খানিকটা ভয় আছে ওঁর। আবার মেয়ের জন্যে উদ্বেগ। একা থাকলে উদ্বেগ আরও বাড়ে।
বিনুর মাকে এতটা ভাল, সহজ হতে দেখে বোধন একবার সুকুমারদার কথা ভাবল। বলবে নাকি ওঁকে কথাটা? বিনুর কাকা কি বোধনকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না?
সঙ্কোচ কাটিয়ে বোধন বলল, আপনাকে একটা কথা বলব বলব ভাবি। বোধন লজ্জা পাচ্ছিল।
অনুপমা বোধনের মুখ দেখছিলেন। কী কথা?
বোধন আবার ইতস্তত করল। সুকুমারদা বলছিল, কাকার যা হাত তাতে একটা যেমন-তেমন চাকরি আমার করিয়ে দিতে পারেন।
অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। ভাবলেন। বলব।
বোধন খুশি হল। বোধ হয় প্রশ্রয়ও পেল। বলল, আমার বাবা একরকম ইনভ্যালিড। অথর্ব। মা চাকরি করেন। আমার একটা কিছু হলে ভাল হয়। বেকার বসে আছি।
অনুপমা সামান্য মাথা নাড়লেন। শুনেছেন তিনি। জানেন।
তুমি বসো, আসছি। অনুপমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। উঠলেন, হাতে চায়ের কাপ। বোধনের কাপ প্লেটও তুলে নিলেন। নিয়ে চলে গেলেন।
আজ দিন ভাল যাচ্ছে বোধনের। বিনুর মাকে মনে করিয়ে দিতেই টাকা পেয়ে যাচ্ছে। চাকরির কথাটাও বলতে পারল মুখ ফুটে। বিনুর মা বললে কাকা কি চেষ্টা করবেন না?
মোটর বাইকের শব্দ আসছিল। শব্দটা যেমন হয় বাড়তে বাড়তে বাড়ি কাঁপিয়ে কিছুটা দূরে চলে গেল। এ নিশ্চয় সেই কালোয়ার টাইপের লোকটা, যে টিনের শেড বানিয়ে স্ক্র্যাপ আয়রনের কারবার করছে। লোকটা আগে সাইকেল চেপে আসত, এখন পুরনো মোটর বাইক কিনেছে বোধ হয়। ওদেরই হয়। ছেঁড়া কাগজ, ভাঙা কাঁচ, ফুটো গামলা থেকেও এরা টাকা করে নেয়। বোধনরা পারে না। বিনুর মা কি এই লোকটাকে দেখে ভয় পান? কেন? বেটা কি এখানে কোনও বেয়াদপগিরি করছে? চোখ রাখতে হবে তো! সুকুমারদাকে বলবে বোধন।
আর ঠিক এই সময় ঝপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। এই ছিল, এই নেই। পলকের মধ্যে সব ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আলো চলে গেল। তার মানে সাত সাড়ে সাত হল। মোটামুটি এই সময় যায় এ-পাড়ায়, আসতে আসতে নটা তো বাজবেই। দেরিও হতে পারে।
অন্ধকারে বসে থাকল বোধন।
বিনুর মা এবার লণ্ঠন জ্বালবেন। কিংবা মোমবাতি।
বোধন অপেক্ষা করতে লাগল। ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছে না। আলো নিবলে এই যাঃ কিংবা গেল এবার এরকম একটা আঁতকে ওঠার শব্দও শোনা যায় বোধন তেমন কোনও শব্দ শুনতে পেল না। বিনুর মা কি লণ্ঠন খুঁজছেন? মোমবাতি পাচ্ছেন না? কিন্তু কোনও শব্দ নেই কেন? হাঁটাচলার শব্দ, পায়ের শব্দ, হাতড়ানোর শব্দ–কোনও কিছুই শোনা যাচ্ছে না! একফোঁটা আলোও আসছে না ভেতর থেকে। আশ্চর্য।
বোধন অপেক্ষা করতে লাগল। কান পেতে রাখল।
অদ্ভুত তো! বিনুর মা কি বাড়িতে নেই। বাড়ি ছেড়ে যাবেনই বা কোথায়? কেনই বা যাবেন?
প্রথমে গলার শব্দ করল বোধন, আশা করল ভেতর থেকে সাড়া আসবে। এল না।
রীতিমতো অবাক হয়ে বোধন এবার ডাকল, মাসিমা?
কোনও সাড়া নেই।
মাসিমা? বোধন আরও জোরে ডাকল।
এবারও কোনও জবাব এল না।
হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে গেল বোধন। কী হল বিনুর মার।
বোধনের পকেটে দেশলাইও নেই। এখন সে কী করবে? উঠে পড়ল বোধন। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ঘরের বাইরে এল। সদর বন্ধই মনে হচ্ছে। পাশের ঘরের দরজা খোলা বোধ হয়, ওটা বিনুর ঘর। তারপর মাঝখানে একটু প্যাসেজ, প্যাসেজের গায়ে পাশাপাশি দু ঘরে বিনুর মা আর কাকা থাকেন। বোধন এবাড়িতে নতুন নয় বলে ঘরগুলো চেনে। শোওয়া, বসা, রান্না, এই তো ঘর। বিনুর মা কোথায়? কোন ঘরে? মাসিমা, বোধন ডাকল, দু পা সাবধানে এগিয়ে আবার মাসিমা? …অদ্ভুত বাড়ির মধ্যে কোথাও কোনও শব্দ নেই, আলো নেই। মানুষটা কি হারিয়ে গেল? বোধনকে ভয় দেখাচ্ছেন? মজা করছেন? বিনুর মা মজা করার মানুষ নন। কেনই বা করবেন! বোধন ভয়ে, উৎকণ্ঠায় দিশেহারার মতন হয়ে পড়েছিল। একটু আলো থাকলেই কী হয়েছে দেখা যেত। কিন্তু আলো কই? বোধন কেন যে একটা দেশলাই রাখে না পকেটে!
আন্দাজে, হাতড়ে হাতড়ে বোধন রান্নাঘরের দিকে চলল। বাঁ দিকে রান্নাঘর। বোধন দেখেছে। দেশলাই রান্নাঘরেই থাকবে। আলো না জ্বালা পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছে না।
বোধ হয় পথে একটা মোড়া ছিল; পায়ে লেগে উলটে গেল, একটা পাপোশ-গোছের কিছু, প্লাস্টিকের বালতি বা ঝুড়িতে পা আটকাল। কিছু একটা হয়েছে বিনুর মারনয়তো এতক্ষণ কেন তিনি সাড়া দেবেন না, আলো জ্বালবেন না!
রান্নাঘর খুঁজে পাবার পর বোধন দেশলাই খুঁজতে গিয়ে বাসনপত্র ফেলে দিল, কাপ প্লেট ভাঙল, চিনির কৌটো হোক বা অন্য কিছু উলটে ফেলল। শেষে হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই পেল। এতক্ষণে খানিকটা ভরসা পেল বোধন।