সোফায় বসে বোধন ঘরের চারদিক দেখতে লাগল। নতুন করে দেখার কিছু নেই। চেনা ঘর। সাধারণ সোফা সেট, বাড়তি চেয়ার, জানলা ঘেঁষে রাখা অর্ধেক গোল টেবিল, বুক কেস, ক্যালেন্ডার, ছবি, বড়সড় রেডিয়ো সেট, প্লাস্টিকের ফুল–মোটামুটি এই। বোধন এমন কিছু এখানে দেখে না যা নতুন দেখলে তাকে অবাক হতে হবে। বোধন এসমস্তই দেখেছে, তাদের বাড়িতেও এক সময় এসবই ছিল, উনিশ বিশ তফাত থাকতে পারে, তবে ছিল আজ নেই।
বিনুদের বাড়ির আসবাবপত্র দেখে বোধনের কোনওদিনই মনে হয় না, ওরা তেমন পয়সাঅলা লোক। সচ্ছল নিম্নমধ্যবিত্ত যেমন হয় তেমন। এই বাড়িও কোনও প্রাসাদ নয়। তবে নতুন বাড়ি, খানিকটা তকতকে হয়ে আছে, বেশ খানিকটা ফাঁকাও। ভাড়াও শ চারেক। আজকাল বাড়িভাড়া এই রকমই। বরং বিনুরা চার ঘরঅলা, খাবার জায়গা রান্নাঘর, বাথরুম সমেত বাড়িটা কমেই পেয়ে গিয়েছে। আরও একশো বেশি হতে পারত।
ভেতরে শব্দ-টব্দ হচ্ছিল। বিনুর মা হাঁটাচলা জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছেন। কাশলেন। বোধন বসে থাকল। আজ সে টাকাটা বিনুর মার কাছে চাইবে। লজ্জা করবে না। টাকাটা দরকার বোধনের। মা আজ অফিস যায়নি। পায়ের ব্যথা বেড়েছে। দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে মার। বোধন যদি পারে আজ একবার সাহা ডাক্তারের কাছে যাবে, কাল সকালেই মাকে দেখিয়ে নেবে। প্যান্টটা আনার কী হবে কে জানে! যদি মার জন্যে কুড়ির মধ্যে খরচ হয়–বোধন প্যান্ট নিয়ে নেবে। নয়তো পারবে না।
আমার যে কী হয়েছে কে জানে! বিনুর মার গলা পেয়ে বোধন তাকাল।
অনুপমা বসার ঘরের চারদিকে তাকালেন, আলমারি খুললাম। রিপোর্ট বার করে দিলাম, টাকা দিলাম–তারপর চাবিটা যে কোথায় রাখলাম–আর পাচ্ছি না।
বোধন অকারণে ঘরের চারদিকে তাকাল, যেন চাবিটা খুঁজছে।
অনুপমা রেডিয়োর আশপাশ, টেবিল, ফুলদানি, সোফা দেখলেন। আছে কোথাও, পাব ঠিকই।
মেঝেতে পড়ে যায়নি তো?
মেঝেতে? না, মেঝেও তো দেখলাম। অনুপমা যেন মনে মনে আরও একবার ঘরের মেঝে দেখে নিলেন। যাকগে, পরে খুঁজব। আচ্ছা তোমায় একটা কথা বলি, আমাদের বাড়ির পেছন দিকে ওই যে একটা টিনের চালা আছে, লোহা-লক্কড় পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে একটা ভাঙাচোরা টেম্পো এসে দাঁড়ায়–ওটা কীসের ঘর? কথা বলতে বলতে চশমা খুলে রেখে দিলেন অনুপমা।
বোধন বুঝতে পারল। বাড়ির পেছনে মানে অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দুরে টিনের চালাটা। বলল, পুরনো লোহা স্টক করে, আবার বেচে দেয়।
দু তিনজনকে দেখেছি, আমাদের এদিকে ঘুরোঘুরি করে। তাদের মধ্যে একটাকে দেখলে ভয় হয়। গুণ্ডা বদমাশের মতন দেখতে। বলে অনুপমা একটু থেমে আবার বললেন, বিনুর কাকা বলছিল, ওখানে নেশাভাঙ চলে।
বোধন অবাক হল না। চলতেই পারে নেশাভাঙ। কোথায় চলে না!
তুমি একটু থেকে যাও। কোনও কাজ নেই তো? আমার শরীরটাও আজ ভাল নেই। দাঁড়াও তোমার চা নিয়ে আসি। অনুপমা চলে গেলেন।
বোধন বুঝতে পারল, বিনুর মা তাকে আটকে রাখতে চাইছেন, যতক্ষণ পারা যায়। মহিলা একটু ভয় পেয়েছেন বোধ হয়। ভয়ের যে একেবারেই কিছু নেই তা নয়, তবে এই সন্ধেবেলায় দরজা ভেঙে চুরি ডাকাতি হবে যে তারও কোনও কারণ নেই। গায়ের পাশে বাড়ি না থাকলেও কাছাকাছি বাড়ি আছে। লোকজন চলছে রাস্তায়। দুর্গা মিষ্টান্ন, মধুসূদন ভাণ্ডার খোলা। বোধনের অবশ্য বসতে আপত্তি নেই। বসে থাকলে কথায় কথায় টাকার ব্যাপারটা সহজে তুলতে পারবে। বিনুর কথাই আবার মনে পড়ল। বিনুকে তো ভালই দেখাল আজ কালকের তুলনায়। তবে ডাক্তারের কাছে কেন গেল?
অনুপমা চা নিয়ে ফিরে এলেন। চায়ের সঙ্গে প্যাষ্ট্রি। বললেন, খাও, বিনুর কাকা এনেছে। ভাল জায়গা থেকে।
আবার চলে গেলেন। ফিরেও এলেন সামান্য পরে। নিজের জন্যে চা এনেছেন। বসলেন মুখোমুখি।
আমাকে একজন সারাদিনের লোক জোগাড় করে দাও না। বড় অসুবিধে হয়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থাকবে। অনুপমা বললেন।
আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তাকে বলব। বলল।
আমি কম টাকা দেব না। …টাকায় আটকাবে না। তবে একশো দুশো চাইলে অন্য কথা।
টাকার কথাটা উঠে পড়ায় বোধন ইতস্তত করে বলল, একটা ব্যাপারে আমার কিছু টাকার দরকার পড়েছে।
অবাক হতে যাচ্ছিলেন অনুপমা, সঙ্গে সঙ্গে কিছু মনে পড়ে গেল বোধহয়।
তোমাকে তো টাকাই দিইনি এ মাসে। তাই না। ছিছি, মনেই পড়েনি। তুমিও কিছু বলোনি৷ কী লজ্জার কথা বলো তো! তা তুমি একবার মনে করিয়ে দিলে পারতে। আজকাল পাঁচ ঝামেলায় আমার সব কথা মনে থাকে না। অনবরত ভুল হয়। মেয়েই আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে।
কী হয়েছে বিনুর? বোধন জিজ্ঞেস করল।
কী জানি! কমাস মাত্র আগে টানা ভুগে উঠল। তখন বুকের এক্সরে হল দু দফা, রক্ত থুতু কত কী পরীক্ষা করানো হল। কিছু পায়নি। এম গাঙ্গুলী–খুব বড় ডাক্তার, তিনি দেখেছিলেন। তাঁর কাছেই আবার পাঠালাম, বুক ব্যথা বুক ব্যথা বলছে।
বোধন চা খেতে লাগল। বিনু বড় রোগা। টিবি হয়ে যাবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে বোধন এই খারাপ চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। না, না; তা কেন হবে। বুকে ব্যথা বোধনেরও হয়েছিল। কার না হয়। ঠাণ্ডা লেগেছে।
চা খেতে খেতেই, অনুপমা বললেন, তোমার টাকাটা এনে দিই।
যাবার সময় নেব।
তা নেবে। আগে দেখি বাইরে অত টাকা রেখেছি নাকি? বিনুর কাকাকে টাকা বের করে দিলাম আলমারি থেকে। রাখতেও পারি। না রাখলে চাবি খুঁজতে হবে।