বোধন মার গলা শুনতে পেল। উঠেছে। চুয়া তাড়াতাড়ি চা ঢালতে লাগল।
.
০৫.
বোধন দরজায় এসে দাঁড়াতেই বিনুর মার গলা পেল। তার পরই দরজা খুলে গেল। অবাক হল বোধন।
তোমার কথাই ভাবছিলাম, অনুপমা বললেন, আসছ দেখলাম। একটা ট্যাকসি ডেকে দিতে পারো?
ট্যাক্সি?
বিনুকে নিয়ে ওর কাকা বিবেকানন্দ রোড যাবে। ডাক্তারের কাছে। দেরি হয়ে গিয়েছে।
বিনুর কি আবার জ্বর এসেছে?
না, যাবার কথা ছিল।
বোধন কিছু বুঝল না। আবার ফিরে চলল ট্যাক্সি ডাকতে। আজ দিন ভাল। বৃষ্টি মেঘ কোথাও কিছু নেই৷ সন্ধে হয়ে গিয়েছে। মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন হবে না। কলকাতার দিকে ফিরতি যেতে হলেই ট্যাক্সি যেতে চায়।
কিন্তু বিনুর কী হয়েছে? জ্বর যদি না হয়, কী হতে পারে। ডাক্তার দেখাতে বিবেকানন্দ রোডই বা কেন? এখানেই তিন চারজন ডাক্তার রয়েছে। সাহা মন্দ ডাক্তার নয়। হয়তো বিবেকানন্দ রোডের ডাক্তার বিনুদের পরিচিত, পুরনো। কিন্তু বিনুরা তো আগে বিবেকানন্দ রোডে থাকত না। প্রাচী সিনেমার দিকে থাকত।
বোধন হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের দিকে চলল। যাবার সময় মনুয়াকে দেখতে পেল। একা একা একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মুখ ভরতি দাড়ি, রোগা, গায়ের জামা ঢলঢল করছে, এলোমেলো প্যান্ট। মনুয়াকে এই রকমই দেখা যায়, মুখ নিচু করে হেঁট মাথায় হাঁটছে একা একা। কাছে গিয়ে ডাকলে তাকাবে। চোখ ফাঁকা, বাঁ চোখের পাতা মণি ঢেকে ফেলেছে, নাক বেঁকা, মনুয়া তাকাবে, চিনতে পারবে হয়তো, কিন্তু চিনলেও কথা বলবে না। বড় জোর ঠোঁটে পাতলা, বিষণ্ণ একটু হাসি ফুটবে।
মনুয়া আজকাল নেশা করে। বোধন শুনেছে, গাঁজা খায়। এ-পাড়ায় ড্রাগসও চলে। চলতি নাম আচার। অনেকেই খায়, মদও মারে।
যারা খায় খাক, বোধন তাদের জন্যে ভাবে না। কিন্তু মনুয়াকে এই অবস্থায় দেখলে তার বড় কষ্ট হয়। মনুয়া যে বোধনের বন্ধু ছিল তা নয়, চেনাজানা ছিল। মনুয়া ডাক্তারি পড়ত। সেকেন্ড ইয়ার। ঝকঝকে ছেলে ছিল। ক্রিকেটে নেশা ছিল। বল করত বেশ। সেই মনুয়া রাতারাতি পালটে যেতে যেতে একেবারেই অন্য রকম হয়ে গেল। তাকে আর পাড়ায় দেখা যেত না। মনুয়া বাড়ি ছেড়ে দিল। তারপর একদিন শোনা গেল, মনুয়াকে ব্যারাকপুরে পুলিশ ধরেছে। বছর আড়াই পরে মনুয়া বাড়ি ফিরল, একেবারে অন্যরকম, বাঁ চোখ প্রায় নষ্ট, নাকের হাড় ভাঙা, ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেঁতলানো। রোগা কাঠি হয়ে গিয়েছে মনুয়া, পা টেনে টেনে হাঁটে। বাড়ি ফিরে মনুয়া দেখল, বাবা মারা গিয়েছে, মা আগেই গিয়েছিল, বাড়ির অভিভাবক দাদা। মনুয়া বাড়িতে ফিরল, কিন্তু স্নেহ, মমতা, আন্তরিকতা পেল না। বাবা নেই; দাদা কোনও টান দেখাল না। বরং মনুয়া আসায় বিরক্ত, বিব্রত, অসন্তুষ্ট হল। দাদা ভাল চাকরি-বাকরি করছে, বাহারি বউ, ছোট ভাইকে পরিবারের পক্ষে স্বস্তিদায়ক মনে করতে পারল না। নিজেদের সুখস্বস্তি শান্তির পক্ষে মনুয়া যেন কেমন বিয়ের মতন। বাড়িটা বাবার, মানে বাবা করেছিল, কাজেই মনুয়াকে তাড়াতে পারে না, সে-অধিকার তার নেই বলেই বাধ্য হয়ে ঠাঁই দিতে হয়েছে ভাইকে নয়তো দিত কিনা কে জানে! বোধন এসব কথা নিজে জানে না, সুকুরমারদার কাছে শুনেছে।
মনুয়া এখন কিছু করে না। বাড়িতেই থাকে। সকালের দিকে কদাচিত তাকে বাইরে দেখা যায়। সে বাজারে আসে না, আড্ডা মারে না, বন্ধুদের সঙ্গে বসে না, রাস্তায় ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায় না। সন্ধের দিকে কিন্তু মনুয়াকে চোখে পড়ে, একা একা আপন মনে, মুখ নিচু করে, নেশায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। যেন মাঝ রাস্তাটা সে অন্যদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে, যাও তোমরা-যাও, আমি তফাতেই থাকলাম।
বোধন মোড়ে আসতে না আসতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল। ধরল ট্যাক্সিটাকে।
ফেরার সময় দেখল মনুয়া ঠিক আগের মতনই হেঁটে যাচ্ছে।
বিনুরা তৈরি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
ট্যাক্সি আসতেই বিনুর কাকা গিরীন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। ঘড়ি দেখলেন। নাও, বিনু নাও, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করব। বলে ড্রাইভারকে বললেন, ভাই, একটু তাড়াতাড়ি। আমার ডাক্তার না চলে যায়। বিবেকানন্দ সেন্ট্রাল অ্যাভিন ক্রসিং।
বিনু এসে ট্যাক্সিতে উঠল। পরনে শাড়ি। উঠতে উঠতে বলল, কাল নিশ্চয় আসবে।
গিরীন উঠে পড়লেন।
ট্যাক্সিটা চলে গেল।
বোধন দু মুহূর্ত ট্যাক্সি দেখল, তার পর মুখ ফিরিয়ে বিনুর মাকে।
বিনুর মা পাছে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যান বোধন কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অনুপমা বললেন, এসো, ভেতরে এসো।
বোধন অবাক হল। বিনুর মা এমন করে ডাকবেন সে আশা করেনি। টাকার কথা বলবে বলে বোধন আজ এসেছে। উনি দরজা বন্ধ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলে বোধনকে সদরে দাঁড়িয়েই টাকার কথা বলতে হত। যাক, ভালই হল।
বোধন ভেতরে এল। দরজা বন্ধ করলেন অনুপমা।
বসার ঘরে আলো জ্বলছিল। তোমার কোনও তাড়া নেই তো! একটু তা হলে বসো। চা খেয়ে যাও। বলেই আবার অন্যমনস্ক হয়ে নিজের মনে কথা বলার মতন করে বললেন, কোথায় যে চাবিটা ফেললাম। খুঁজে আলমারিটা বন্ধ করে আসছি।
অনুপমা চলে গেলেন।
বোধন বিনুর মাকে ঠিক এতখানি সহজ হতে আগে বিশেষ দেখেনি। মহিলা অবশ্য কোনওদিনই অভদ্রভাবে কিছু বলেননি বা করেননি, তবু আজ তাঁর ব্যবহার আরও নরম, সহজ মনে হচ্ছিল। কেন, কে জানে!