জবাদি মানুষটা বড় ভাল। এই বাড়িতে তার কোথায় যেন এক মায়া পড়ে গিয়েছে। এক-পা কাটা খোঁড়া বাবু, অফিস-ছোটা মা, নিষ্কর্মা দুই দাদা দিদি–সব যেন কেমন মন্দ কপালের ব্যাপার। বোধ হয় জবাদির করুণা হয়। মমতাও। অন্তত বাবার ওপর জবাদির যে করুণা বেশি সেটা বোঝা যায়। বাবাকে কখনওই ছেড়ে কথা বলে না মা। যখন তখন খোঁচা মারে। কারণে অকারণে চেঁচামেচি, গালমন্দ করে। বোধন দেখেছে, মা যখন বাড়াবাড়ি শুরু করে, জবাদি চোখের ইশারায়, কখনও বা নিচু গলায় মাকে চুপ করতে বলে। মা অবশ্য পরোয়া করে না, কিন্তু জবাদিকেও তেমন কিছু বলে না। হয়তো স্বার্থের জন্যেই। পঁচিশ টাকা মাইনে আর দু বেলা দু কাপ চা, খান দুয়েক শুকনো রুটির বদলে জবাদির মতন কাজের লোক মা কোথায় পাবে! কাজ তো কম নয় জবাদির: বাসন মাজে, একবেলা শুধুই ঘর ঝাট, অন্য বেলায় ঘর মোছা, মশলা বাটা, দায়ে-অদায়ে তরি-তরকারি কুটে দেওয়া, এমনকী রান্না বান্নাতেও অল্প-স্বল্প সাহায্য। জবাদি ছাড়া এত আর কে করবে!
চুয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।
বোধন মুখ ধুতে যাবার সময় দেখল, রান্নাঘরে উনুন ধরে গিয়েছে। চুয়া খেয়াল করেনি, চায়ের জল না বসিয়ে ঘরে চলে গিয়েছে চোখমুখ মুছে, কাপড় চোপড় ঠিক করে পরে আসতে। মার চোখে পড়লে গালাগাল খেত। মা এসব একেবারে দেখতে পারে নাঃ উনুনের আঁচ নষ্ট হবে আর তুমি ঘরে দাঁড়িয়ে গাল মুছবে–কোন নবাবের বেটি তুমি৷ কেন, চোখ চেয়ে দেখতে পারো না একটু। কয়লা কি বিনি পয়সায় আসে!
মা কথা শুরু করলে থামে না, একটা থেকে আর-একটায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। বাড়ি ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, কয়লা কেরোসিন তেল, চাল, গম–পর পর মুখে এসে যায় মার। যায়, কেন না এ-সংসার মা চালায়, মার হাড়ভাঙা খাটুনি, গায়ের রক্তে তাদের খাওয়া-পরা।
বোধন মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখল, চুয়া রান্নাঘরে। চায়ের জল চাপাচ্ছে।
খুট করে শব্দ হল দরজায়। বাবা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বোধন মুখ তুলে বাবাকে দেখল।
বাঁ বগলে ক্রাচ নিয়ে বাবা ক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। জানলার দিকে তাকাল। তারপর অভ্যেস মতন বলল, বাথরুম ফাঁকা?
হ্যাঁ।
বাবা একদিকে হেলে সামান্য দুলতে দুলতে বাথরুমে চলে গেল।
বোধন ঘরে গিয়ে ব্রাশ রাখল। মুখ মুছল। বাবার জন্যে বড় কষ্ট হয় বোধনের। কষ্ট এবং ঘেন্না। কে বলবে এই বাবা সেই মানুষ! বছর ছয় আগেও বাবা স্বাভাবিক ছিল, সুস্থ ছিল। সেই সক্ষম, লম্বা চওড়া মানুষটা আজ কেমন অথর্ব, অক্ষম, দীন হয়ে গিয়েছে। দেখতেও নোংরা-নোংরা লাগে। মুখে দাড়ি জমে তিন চার দিন, তারপর একদিন সস্তা ব্লেডে দাড়ি কামাবার পরও মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি জমে থাকে, কোনওদিনই আর বাবার মুখ পরিষ্কার হয় না। মাথার চুল রুক্ষ, লালচে হয়ে গিয়েছে। ঘাড় কাঁধ কালো, ময়লা জমছে তো জমছেই। বাবার গলাও কেমন ভাঙা ভাঙা, জড়ানো শোনায়। গলার স্বর দিন দিন নিচু হয়ে যাচ্ছে, আজকাল প্রায়ই কথা বলতে গিয়ে তোতলায়। নিজের ওপর আর কোনও আস্থা নেই, কোনও কর্তৃত্ব নেই বলেই বোধ হয়। বাবার চোখ দেখলে বোধনের মনে হয়–মানুষটার চোখ ফাঁকা, মন ফাঁকা, গ্লানি আর লজ্জায় মরা-মরা, কুণ্ঠিত। বড় অসহায় আর অপরাধীর মতন দেখায় বাবাকে। আবার ঘেন্নাও হয়! কেন, কেন মানুষটা এরকম হল?
বোধন বাইরে এল। বাথরুমে বাবার গলা পরিষ্কারের শব্দবমি করার মতন।
বোধন টেবিলের একপাশে বাবার চেয়ারটা ঠিক করে রাখল। কাঠের চেয়ার। হাতল আছে। এই চেয়ারটায় বাবা বসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে এখন বসবে, আর বেলা বারোটা পর্যন্ত একটানা এখানেই বসে থাকবে। দরকার না পড়লে বাবা উঠবে না। এই চেয়ার আর এই টেবিলটাই বাবার সব। সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত এখানে, দুপুরে এক দু ঘণ্টা হয়তো নিজের ঘরে বিছানায়, তারপর আবার বিকেলের গোড়া থেকে রাত পর্যন্ত যতক্ষণ না খাওয়া-দাওয়া শেষ হচ্ছে। এই কাঠের চেয়ার, ওই টেবিল আর সামনের জানলাটুকুই বাবার জগৎ। কেমন জগৎ কে জানে! বোধন জানে না। তবে মনে মনে বোঝে, এইটুকুর মধ্যে বাবা নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে আজ যেন খাঁচায়-পোরা জীবজন্তুর মতন নির্জীব হয়ে গিয়েছে।
বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল।
বোধন রান্নাঘরে ঢুকল।
চা হয়েছে রে?
ভিজিয়েছি।
চুয়া একটা ভাঙা কাপে গুঁড়ো দুধ গুলছিল। গঁড়ো চা, গুঁড়ো দুধ, এক রত্তি চিনিনা থাকলে গুড়ের বাতাসা দিয়ে চা। এক বোতল হরিণঘাটা আগে আসত, অনেকদিন আগে, তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তোর কাছে, বোধন নিচু গলায় বলল, টাকা পয়সা কিছু আছে?
টাকা! কেন?
মার গোড়ালিটা একবার সাহা ডাক্তারকে দিয়ে দেখিয়ে নিতাম। ডিসপেনসারিতে গেলে চারটে টাকা নেবে।
না, আমার কাছে নেই।
একেবারে নেই?
যা আছে তাতে আমায় চালাতে হবে। বাবা গত হপ্তায় পাঁচটা টাকা নিয়েছে। বলেছিল দেবে। দেয়নি।
বাবা কোথা থেকে দেবে?
তা আমি কী জানি! মার কাছ থেকে চেয়ে দেবে।
বোধন বোনের মুখ দেখল। অবাক হল না। চুয়া এই রকমই হয়েছে। স্পষ্ট, ঠোঁট কাটা, জেদি। আজকাল সে টাকা-পয়সা রোজগার করে। অল্প-স্বল্প। একটু-আধটু গানের গলা ছিল ছোটবেলা থেকে। মানিকতলায় থাকার সময় একজন মাস্টারও ছিল কিছুদিন। তারপর পাড়ার স্কুলে যেত। শেষে সব বন্ধ হয়ে গেলেও চুয়া নিজের মতন রেকর্ড রেডিয়ো শুনে-টুনে গান শিখত। এই করে করে শেষে, এখানে আসার পর একদিন চুয়া গেল থিয়েটার করতে। কোন ক্লাব নিয়ে গেল। তারপর থেকে ডাক পাচ্ছে। আজকাল মাঝেমাঝেই। টাকাও পায়।