অবনী কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা অফিসে চলে গেল। এখন এখানে কুলিমজুর বা ভিড় থাকার কারণ নেই। অফিসের চাকরবাকর, কেরানি আছে কয়েকজন। মোটামুটি জায়গাটা শান্ত। বর্ষার জলে কাদা হয়েছে যেমন, ঘাসও হয়েছে প্রচুর। সবই ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল।
নিজের ঘরে গিয়ে অবনী চেয়ারে বসল। বেয়ারা টেবিল চেয়ার মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে, জানলাও খোলা। সামনের দেওয়ালেই নানান রকম ব্লু-প্রিন্ট ঝোলানো, একটা ক্যালেন্ডারও ঝুলছে, বড় বড় তারিখ।
অবনী চেয়ারে বসে হাত বাড়িয়ে ঘন্টি টিপল। বেয়ারা এল। সকালে আসা ডাকের চিঠিগুলো কেরানিকে দিয়ে দিতে বলল। চিঠিপত্র তার দেখতে ইচ্ছে করছে না।
উন্মনা হয়ে বসে থাকল অবনী। জানলা দিয়ে কখনও আকাশ দেখল, কখনও জামগাছ। মুখ ফেরালেই দেওয়ালে টাঙানো নকশাগুলো চোখে পড়ছিল। বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা হবার পর কেন যেন তার সুরেশ্বরদের কথাই মনে পড়ছে। হয়তো হৈমন্তীর জন্যে। বিজলীবাবুর মতন তারও অসীম কৌতূহল মেয়েটি সম্পর্কে। ও কে, কেন এখানে এল? সুরেশ্বরের সঙ্গে কী সম্পর্ক হৈমন্তীর?
সুরেশ্বরের আশ্রম থেকে আসার সময় সুরেশ্বর বলেছিল, আজ সকালে তার শহরে দরকার আছে, বৃষ্টি বাদলা না হলে যাবে, শহরে গেলে হীরালালের খোঁজ নেবে। সুরেশ্বর কি শহরে গিয়েছে? না কি, কাল অবনী পথের বিপন্ন মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বলে ওটা সুরেশ্বরের ভদ্রতা, স্তোক দিয়েছে।
মানুষটাকে আর যাই হোক, ঠিক বাজে, ধাপ্পা-মারা তোক বলে অবনী মনে করতে পারে না। আজকের দিনে কী করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত, জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষমানুষ আশ্রম খুলে বসতে পারে অবনীর তা মাথায় না ঢুকলেও লোকটাকে এসব ব্যাপারে একেবারে অবিশ্বাস করা যায় না। হয়তো সুরেশ্বর সত্যিই শহরে গেছে।
কাল ওই অবস্থার মধ্যেও অবনী কিন্তু বেশ অবাক হয়েছে। কোথাকার কোন গুরুডিয়া–যেখানে যাওয়া-আসার ভাল পথ নেই, চারদিক জঙ্গল আর পাহাড়ি গাঁ গ্রাম সেখানে সুরেশ্বর আজ তিন-চার বছর ধরে আস্তে আস্তে সত্যিই একটা অন্ধ আশ্রম করে ফেলল। সুরেশ্বরদের নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় কতটুকু আর ঠাওর করা যায়–তবু ওরই মধ্যে ম্লান জ্যোৎস্নায় যেটুকু দেখেছে অবনী তাতে অবাক হয়েছে। মানুষটা কাজের, অন্তত একথা বলা যাবে না, সুরেশ্বর ধুনি জ্বেলে সেখানে বাবাজি হয়ে বসে আছে।
এই সুরেশ্বর, বছরখানেক আগে একবার অবনীর কাছে কিছু সাহায্যের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিল। অবনী যতটুকু পারে, যা পারে। অবনী সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল, বলেছিল–ক্ষমা করবেন; ওসব আমি দিই না। …হয়তো এভাবে প্রত্যাখ্যান না করেও অবনী কিছু দিতে পারত, যেমন অন্যান্য জায়গায় দিয়ে থাকে, ভদ্রতা করে বা দয়া করে। সুরেশ্বরের বেলায় অবনী ইচ্ছে করেই মুখের ওপর না বলেছিল। কারণ এই ধরনের মানুষকে সে আঘাত করতে চায়।
সুরেশ্বর কী ধরনের মানুষ?
আশ্রম-ফাশ্রমে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আমি ও-সব বিশ্বাস করি না। অন্ধদের জন্যে কিছু করতে হলে দরকার হাসপাতালের। দরকার ডাক্তার। আপনি কি ডাক্তার? হাসপাতাল খুলবেন জঙ্গলে?
আমার তো কোনও সম্বল নেই। চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে যতটা পারি।
সম্বল যখন নেই তখন করছেন কেন?
আপনাদের সাহায্য পাব এই আশায়।
তা হলে করুন। আমি কিন্তু আপনাকে নিরাশ করলুম।
তাতে কী!
আশ্চর্য, লোকটা অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও রাগল না, কটু কথা বলল না, আগের মতনই সরল হাসিমুখ করে থাকল, অবনীর দেওয়া চা খেল, অন্য পাঁচটা গল্প করল। তারপর নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। অথচ, অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ এই অপমান সুরেশ্বরকে ভেতরে বিচলিত করেছিল। ওপরে সে তা প্রকাশ করেনি।
এর পরও কয়েকবার দেখা হয়েছে দুজনের, হঠাৎই। সুরেশ্বর প্রসন্ন মুখে কথা বলেছে, গল্প করেছে, তার আশ্রমে যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। অবনীই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়েছে সামান্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে মাখেনি।
আসলে সুরেশ্বরদের মতন মানুষের ওপর অবনীর পরম বিতৃষ্ণা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে সুরেশ্বর যাই হোক, ওরা একটা গোষ্ঠী, সামাজিক দিক থেকে পরিকল্পিত সম্প্রদায়, সুরশ্বরকে তা থেকে আলাদা করা যায় না। জীবনের যাবতীয় রুক্ষ যন্ত্রণা থেকে এরা ভীরুর মতন পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে। ধর্মের নামে, সেবার নামে, মুক্তির নামে। এমন নয় পালিয়ে গিয়ে এরা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। সংসারের সমস্ত রকমের স্বার্থ, ইতরতা, আকাঙ্ক্ষা, মোহকে পালন ও লালন করছে। তবে এই ভেক কেন? এই মিথ্যা কেন?
সাধারণ মানুষের মতন ওদের অন্নের জন্যে পরিশ্রম নেই, প্রাত্যহিক গ্লানি নেই; দায় নেই কোথাও, দায়িত্ব নেই: পিতামাতা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের জন্যে চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই; যে-সব রূঢ় সমস্যা সাধারণ মানুষকে নোখ দিয়ে নিয়ত আঁচড়ায়, গলা টিপে ধরে, আয়ু নিঃশেষ করে নেয় তোমরা সেখান থেকে পালিয়ে গেছ। অথচ ওই বেচারিদের শ্রদ্ধার চাঁদায় তোমরা দিব্যি বেঁচে আছ, আশ্রম গড়ছ, মঠ বানাচ্ছ, মন্দির তুলছ–আর ভক্ত-শিষ্য পরিবৃত হয়ে ধর্মজ্ঞান বিতরণ করছ। অকর্মণ্য, আত্মপরায়ণ, ধাপ্পাবাজ সব।
অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ ছিল, সুরেশ্বর কিছুই করবে না, করতে পারবে না। বড় জোর একটা আখড়া তৈরি করবে নিজের, কাউকে ধরে-পাকড়ে একটা মন্দিরও তুলবে হয়তো, তারপর শাঁখ ঘণ্টা কাঁসর বাজিয়ে, ভক্তসমাগম ঘটিয়ে ছোটখাটো মহাপুরুষ হয়ে অধিষ্ঠান করবে।