বিজলীবাবু সাইকেল থেকে নেমে বললেন, মিত্তিরসাহেবকে দেখলাম কাল রাত নটা নাগাদ ফিরছেন…কোথায় যাওয়া হয়েছিল? টাউনে?
হাসপাতালে।
ও! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ; সেই ছোকরা…। কেমন আছে?
ভাল না, খুবই খারাপ।
আশা নেই?
কোথায় আর!
বিজলীবাবু দুপলক অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কোনও কিছু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করার সময় তাঁর নাক সামান্য কুঁচকে ওঠে, মনে হয় তিনি শুধু চোখ দিয়ে দেখছেন না–গন্ধটাও শুঁকে নিচ্ছেন। ইতর প্রাণীদের মতন বিজলীবাবু ঘ্রাণক্ষমতায় যেন অনেক কিছু বোঝান। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ছাতার বাঁটে হাত বুলিয়ে নিলেন অকারণে। তারপর কপাল দেখাবার ভঙ্গি করে বললেন, নিয়তি। …বলেছে না, নিয়তি কেন বাধ্যতে…। ওখানে মিত্তিরসাহেব, মানুষ ঠুটো, জারিজুরি চলে না।
অবনী কোনও কথা বলল না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই দুনিয়ার এটাই খেলা– বিজলীবাবু এবার হাসবার চেষ্টা করলেন, মাথার ওপর এক শালা পেয়াদা বসে আছে, ঠিক সময় শমন ধরিয়ে দিয়ে কাছারিতে টেনে নিয়ে যাবে। তাই তো বলি, যে কদিন আছ বাপু, খেয়েদেয়ে ফুর্তি-আরাম করে কাটিয়ে দাও। চার্বাক ঋষিটিষি বলেছেন, যাবৎ জীবেৎ সুখ জীবেৎ… খাঁটি কথা।
অবনীর হঠাৎ এ সময় সুরেশ্বরের কথা মনে পড়ল। কী যেন বলেছিল কাল সুরেশ্বর…? পৃথিবী এবং আকাশ আমার শবাধার…চন্দ্র সূর্য তারা…
বিজলীবাবু ততক্ষণে পকেট থেকে সিগারেট বের করে এগিয়ে দিয়েছেন। আসুন–একটা কড়া খান।
অবনী অন্যমনস্কভাবেই সিগারেট নিল। বিজলীবাবু তাঁর সিগারেট কে-এ মিক্সচারঅলা সিগারেট পাকিয়ে রাখেন, বন্ধুবান্ধবকে দিতে হয় বলে পাকানোর সময় উচ্ছিষ্ট করেন না।
দুজনেই সিগারেট ধরাল। অবনী বলল, আপনার বাস যে মশাই প্রায়ই দেখি রাস্তায় খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল ফেরবার পথে এক ঝামেলা। সুরেশ্বর একটি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিল, পথে আটকা পড়েছে। তাদের আবার পৌঁছে দিলাম।
আজ সকালে শুনলাম। বাসের আর কী দোষ বলুন, ভাগে মা-মালিক থেকে শুরু করে ক্লিনারসব বেটাই কিছু কিছু করে ভাগ মারছে, আমিও মারিভাগে মা গঙ্গা পাবে কোথায়! এই লং ট্রিপ, প্রপার মেনটেনান্স করতে হলে খরচটা কেমন লাগে ভাবুন। জোড়াতালি মেরে চালানো। ওই রকমই হবে। আমার আর কী! …তা কাল আমাদের মহারাজজিকে আপনি পার করলেন! বিজলীবাবুর চোখে কেমন কৌতূহল ও হাসি ফুটল।
অবনী বলল, জায়গাটার কী নাম যেন?
গুরুডিয়া।
রাত্তিরে ঠিক বুঝলাম না, তবে অনেকগুলো ঘরটর করেছে দেখালাম।
দিব্যি করেছে। আপনার বুঝি ওদিকে আগে যাওয়া হয়নি। দিন-দিন যাবেন একদিন, দেখবেন। সুরেশ-মহারাজ, বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, বেশ কাজের লোক। তিন-চার বছর লেগে পড়ে এখন মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।
ভদ্রলোককে আপনি সুরেশ-মহারাজ, মহারাজজি–এসব বলেন কেন? অবনী একটু হেসে বলল। বলার মধ্যে তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না, থাকার কথা নয়; বিজলীবাবু বরাবরই ওই ভাবে কথা বলেন, এবং আগেও দু-চার বার অবনী তাঁকে পরিহাস করে জিজ্ঞেস করেছে কথাটা।
আগে যেমন, এবারও বিজলীবাবু হেসে হেসে জবাব দিলেন, বলব না! গেরুয়া না পরলেও সুরেশ-মহারাজ যে সন্নেসী মানুষ। ভেক যোগী নয়, কর্মযোগী… গীতাটি পড়েছেন নাকি আপনি মিত্তিরসাহেব? আমি পড়িনি, বাড়িতে একটা আছে, হিন্দুর ছেলে, মরার সময় মাথার পাশে রাখতে হবে তো! বিজলীবাবু আপন রসিকতায় মজে গিয়ে হাসলেন। হাসি থামলে হঠাৎ বললেন, সুরেশ-মহারাজ কাল এসেছিলেন, আমার বাস-অফিসে পা দিয়েছিলেন দুদণ্ড। বললেন, কাকে যেন নামাতে এসেছেন। দেখলাম তো, বেশ ডাগর একটি মেয়ে নিয়ে বাসে চাপলেন, মালপত্র সমেত। …তা শুনলেন কিছু? মেয়েটি কে?
চোখের ডাক্তার।
মেয়েরাও চোখের ডাক্তার হয়?
হবে না কেন?
তা ঠিক। পুরুষের চোখ মেয়েরা ভালই বোঝে…মেয়েদের চোখও মেয়েরা আন্দাজ করে ভাল। বাড়িতে তো দেখছি… তা যিনি এলেন তিনি কি সধবা না কুমারী?
জানি না।
সুরেশ-মহারাজের কেউ হয় না কি?
চেনাশোনা।
নিজের কেউ নয়?
বুঝলাম না।
চুপচাপ। দুজনেই বোধ হয় মনে মনে মেয়েটিকে দেখছিল। অবনী হঠাৎ যাবার তাড়া অনুভব করল। বলল, চলি…।
বিজলীবাবুও যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেখেছেন কাণ্ড, আপনাকে লেট করিয়ে দিলাম। আচ্ছা, মিত্তিরসাহেব, চলি। আমি একবার গোপীমোহনের কাছে যাব। …বিকেলে দেখা-সাক্ষাৎ হবে।
বিজলীবাবুর সাইকেল সামনে থেকে সরে যেতেই অবনী অফিসের দিকে পা বাড়াল।
অল্প এগিয়েই অবনীর অফিস। দেখলে অফিস বলে মনে হয় না, কোনও বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ছোটখাটো কারখানা যেমন দেখায় অনেকটা তেমনি চেহারা। কাঁটাগাছের কিছু কিছু বেড়া, তার গা-ঘেঁষে জালি-তার দিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফেন্সিং; প্রায় মাঝ-মধ্যে ইটরঙের ঘন লাল এক ছোটখাটো বাড়ি, মাথায় টালির ছাউনি। ফাঁকা জায়গাটায় নানান জিনিস ছড়িয়ে আছে–লোহার খুঁটি, শালের খুঁটি, হরেক রকম তার, কে-এর চাকা, ভাঙা বাক্স, চিনেমাটির ইনসুলেটার, দু-একটা ভাঙাচোরা ট্রাক, মায় একটা ক্রেনও। আর কত বিচিত্র বস্তু। ওরই মধ্যে কোথাও কয়েকটা করবী গাছ, কলাফুলের ঝোপ। মস্ত একটা হরীতকী গাছ একপাশে তার গায়েই ইঁদারা। বাড়িটা যে ভাড়া নেওয়া বুঝতে কষ্ট হয় না।