বাড়িতেও মানসিক তৃপ্তি বা আরাম বলে কিছু ছিল না। ললিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক চরমে উঠেছিল। বাহ্যত তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও ভেতরে পরস্পরের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ হয়েছিল বিরক্তির এবং ক্লান্তির। ঘৃণার। দাম্পত্য সম্পর্ককে মনে হত পায়ের কাছে ছড়ানো কাচের ভাঙা বাসনের মতন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে, ধারালো কানা চকচক করছে, পা রাখলেই ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে উপায় নেই। এই তিক্ততা সন্তানের মধ্যেও সংক্রামিত হয়ে উঠছিল। অবনীর পক্ষে সেটা কাম্য ছিল না। ললিতা আইন-আদালতের শরণাপন্ন হবার পক্ষপাতী, অবনীও অনিচ্ছুক নয়। সৌভাগ্যক্রমে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি-মতন বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ায় আপাতত তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারল। স্ত্রীকে মুক্তি দিয়ে অবনী দূরে সরে এল। ললিতা মেয়েকে রেখে দিল। ভরণপোষণের টাকাটা সে কোনওভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না।
চায়ের পেয়ালা শেষ হয়েছিল। অবনী সিগারেট ধরাল। তারপর আরও এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল।
এখানের চাকরিটা পেতে তার সময় লাগেনি। যেহেতু সে বাইরে পালাতে চায়, কিছু একটা হলেই হবে–এই মনে অবনী চাকরি খুঁজছিল, কিছু খুঁটিয়ে না দেখেই এখানে দরখাস্ত করেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই জবাব এল। অবনী দ্বিধা করল না। চলে এল। চাকরিটা আধা-সরকারি বললেও বলা যায়। দায়দায়িত্ব তেমন কিছু নেই। হাতে কলমে কাজও নয়। শুধুমাত্র তদারকির আর চিঠিপত্র লেখালেখির। নির্ঝঞ্ঝাট কাজ। ওপরঅলা বলতে মাথার ওপর যিনি আছেন তাঁর অফিস অন্যত্র, বছরে দু-চারবার মুখোমুখি দেখা হয়। একেবারে অপদার্থ, তবে মানুষটি ভাল। অবনীর এই কাজে একটা মাত্র অসুবিধে এই যে, প্রায়ই তাকে কাজকর্ম দেখতে যত্রতত্র যেতে হয়। কিছুটা ছোটাছুটি রয়েছে। তা থাক। সুবিধের তুলনায় অসুবিধে প্রায় কিছুই নয়। থাকার বাড়ি পেয়েছে, অ্যালাউন্স আছে। মাইনে অবশ্য খুব কিছু না। অবনীর তাতে ক্ষোভ নেই।
দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করে অবনী উঠল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘলা কখনও খুব ফিকে, কখনও আবার গাঢ় হয়ে আসছে। বাতাস রয়েছে বেশ, মনে হচ্ছে, বেলায় কিংবা দুপুর নাগাদ মেঘলা। কেটে যাবে।
সামান্য বেলায় অবনী যখন অফিস যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এল তখন তাকে খানিকটা ঝরঝরে দেখাচ্ছিল। সদ্য দাড়ি কামানো মুখ, মাথার চুল সামান্য ভিজে, গায়ে হালকা রঙের বুশ কোট, পাটভাঙা ট্রাউজার পরনে, হাতে ওয়াটারপ্রুফ। বৃষ্টি পড়ছিল না, পথ ভিজে, গাছের পাতায় জল জমে আছে; বাগানের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় অবনী দেখল, কদমতলায় দাঁড়িয়ে মহিন্দর ডিম কিনছে। কাঠের ফটক খুলে অবনী রাস্তায় উঠল।
অবনীকে দেখলে তার বয়স সঠিক অনুমান করা মুশকিল। মনে হয় বছর পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু তার বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। মাথায় বেশ দীর্ঘ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি লম্বা ছাঁদের, মুখ লম্বা এবং শক্ত, কপাল উঁচু, নাক দীর্ঘ, চোখ গভীর করে বসানো। গলাও সামান্য লম্বা। বয়সের মেদবাহুল্য নেই শরীরে, যেটুকু আছে তা না থাকলেও তাকে বেমানান দেখাত না। মনে হয়, অবনী বরাবরই ছিপছিপে গড়নের ছিল, শক্ত ছিল। পিঠের কাছটায় ঈষৎ নুয়ে থাকে, কাঁধ তেমন ভরাট নয় বলেই হয়তো অমন দেখায়। অবনীর মাথার চুল পাতলা, কোঁকড়ানো, ধূসর রঙের। গায়ের রং ময়লা।
প্রথম দর্শনে অবনীকে রূঢ় ও গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয়। সম্ভবত তার চোখের দৃষ্টির জন্যে। তার চোখে অস্বাভাবিক কিছু আছে, বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, অবহেলা এবং উপেক্ষার চোখে সব কিছু দেখাই যেন তার অভ্যেস। নম্রতা বা সৌজন্য, কৌতূহল বা উৎসাহ সহসা তার দৃষ্টিতে দেখা যায় না। অথচ অবনীর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারলে বোঝা যায়, তার হালকা কালো রঙের চোখের মণি এবং ঈষৎ হলুদ রঙের চোখের জমিতে জমিতে কেমন এক মমতা মাখানো আছে। এমনকী কোনও কোনও সময় এই চোখ এবং তার উজ্জ্বল দৃষ্টি অবনীর সুতীব্র কোনও আবেগকেও প্রকাশ করে। সে যে কখনও কখনও অসহায় বালকের মতন বিক্ষুব্ধ, কাতর হতে পারে–আবার মন হালকা থাকলে গলা ছেড়ে হাসতে পারে, অনর্গল কথা বলে, তাস খেলতে পারে–এ অনেকের জানা নেই। যাদের আছে তারা মনে করে অবনী মজাদার মানুষ, চমৎকার লোক। যারা জানে না তারা অবনীকে ভদ্রজন বলে মনে করে না, ভাবে লোকটা অহংকারী, অসভ্য, ইতর শ্রেণীর। এই দুবছরে এখানে সুনাম দুর্নাম দুইই কিছু হয়েছে তার। সুনাম করেছে তারা যারা কমবেশি অবনীর অন্তরঙ্গ হতে পেরেছে, দুর্নাম করেছে তারা যারা ওর ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। সুনাম অথবা দুর্নামের প্রতি এখন পর্যন্ত তেমন কোনও মোহ জন্মায়নি অবনীর।
.
অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা অবনীর। সাইকেলে চেপে বিজলীবাবু কোথাও যাচ্ছিলেন, নেমে পড়লেন। এখানকার বাস-সার্ভিসের ম্যানেজার। প্রায় প্রৌঢ়, তবু শখ শৌখিনতা ছাড়েননি। কাঁচাপাকা চুলে অ্যালবার্ট টেরি কাটেন, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা; মালকোঁচা মারা ধুতির সঙ্গে সাদা শার্ট, শার্টের দুদিকে বুক পকেট। বেঁটেখাটো গোলগাল মানুষ, ধবধব করছে গায়ের রং। গোটা তিনেক আংটি আঙুলে। পান খান প্রচুর। গৃহে যুগল স্ত্রী, বাইরেও নারীসঙ্গ করে থাকেন বলে লোকের বিশ্বাস। বিজলীবাবুর ধারণা, পুরুষমানুষকে স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখতে হয়, তার জন্য শুধু কর্মঠ হলেই যথেষ্ট নয়, পানভোজন ও আনুষঙ্গিকের প্রয়োজন আছে। যেটুকু পাও হাত বাড়িয়ে, ভোগ করে নাও-রেখ না লেশ, নইলে পরে হায় তুমিও করবে কখন ধুলোয় প্রবেশ। ভদ্রলোক ওমর খৈয়মের বাংলা অনুবাদ প্রাণভরে মুখস্থ করেছেন, সুযোগ মতন তার থেকে দুচার লাইন আওড়ে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা অকপটে বুঝিয়ে দেন। অবনীর সঙ্গে বিজলীবাবুর এক ধরনের বন্ধুত্ব আছে। বিজলীবাবু তাঁর বাসের ড্রাইভারকে দিয়ে মাঝে মাঝেই কখনও শহর কখনও অন্য কোনও বড় জায়গা থেকে অবনীর মদ্যাদি আনিয়ে দেন, অবনীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, পালটা আপ্যায়নেও ইতস্তত করেন না।