অবনী কোনও জবাব দিতে পারল না। হয়তো সে তখনও সবটা ভাল বুঝতে পারেনি।
ততক্ষণে সুরেশ্বরের আশ্রমে চলে এসেছে ওরা। সুরেশ্বর আশ্রমের আলো দেখিয়ে বলল, ওটাই আমার আস্তানা। আপনি তো আগে কখনও আসেননি। আজও বড় অসময়ে আপনাকে টেনে আনলাম।
অবনী হেসে বলল, কী নাম আপনার আশ্রমের? …অন্ধজনে দেহ আলো?
গাড়িটা আশ্রমের মধ্যে ঘুরিয়ে ব্রেক করার পর অবনী আবার কাঁধের ওপর হৈমন্তীর হাতের স্পর্শ পেল। যেন অন্ধকারে হৈমন্তী তার কাঁধে ভর না দিয়ে উঠতে পারছে না।
.
০২.
সকালে ঘুম ভাঙার আগে অবনী হীরালালকে স্বপ্ন দেখছিল। ঘুম ভেঙে গেলে সে কয়েক মুহূর্ত হীরালালকে খুঁজল, যেন ভিড়ের মধ্যে হীরালাল কোথাও অদৃশ্য হয়েছে এখুনি ফিরে আসবে। হীরালাল এল না; অপেক্ষা অন্তে হতাশ হয়ে ফেরার মতন আস্তে আস্তে চোখ খুলল অবনী। সকাল হয়েছে, সে বিছানায়, মশারির আড়াল থেকেও বোঝা যায় বাইরে মেঘলা হয়ে আছে, ঘরের মধ্যে আলোর মালিন্য, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে শব্দ করে।
বিছানা ছেড়ে উঠতে অবনীর আগ্রহ হল না। শুয়ে শুয়েই হাই তুলল। কেমন অবসাদে ভরে আছে সব। মাঝে মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত অবসাদ বোধ করে অবনী। এই অবসন্নতা মদ্যপানজনিত নয়, ক্লান্তিবশতও নয়। কী যেন তার শরীর ও মনকে এমন এক অবস্থার মধ্যে টেনে আনে যখন প্রতিটি বিষয়ে সে অনাসক্তি বোধ করে। তার ইন্দ্রিয়গুলি কোনও কিছুতেই উৎসাহ অনুভব করে না। এই অবস্থায় অবনী নির্বিশেষে এমন এক অবহেলা, বিরক্তি আর উপেক্ষার মধ্যে ডুবে থাকে যে তাকে জড়বৎ মনে হয়।
আজ অবনী অন্য এক ধরনের গভীর অবসাদ বোধ করছিল। অবহেলা, উপেক্ষা বা বিরক্তির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং উদাসীনতার সঙ্গে রয়েছে। যেন গতকাল কোনও শব বহন করে সৎকার শেষে সে অতীব ক্লান্ত হয়েছিল, এবং দুঃখভারের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আজ এখন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কেমন এক শূন্যতা অনুভব করছে।
আরও কিছুক্ষণ অবনী চুপচাপ শুয়ে থাকল। হীরালালের কথা ভাবল। হীরালালের কথা ভাবতে গিয়ে কাল সন্ধ্যা ও রাত্রের কথাও তার মনে পড়ল। নিসর্গ চিত্রের বিবিধ দৃশ্যগুলির মতন তার চোখে মাখারিয়ার জঙ্গল, অস্ফুট জ্যোৎস্না, সুরেশ্বর, হৈমন্তী ঝাপসা হয়ে আসছিল। শেষে অবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখের সামনে মশারি সরিয়ে উঠে পড়ল।
বাইরে মেঘলা খুব গাঢ় নয়, জলের মতন হালকা রঙের। জানলার কাচের শার্সিগুলো পুরোপুরি খোলা নয়, শার্সিতে জলবিন্দু, বাইরে বৃষ্টির আঁশ ঝরছে, দূরে স্টেশনে ইঞ্জিনের হুইসল বাজল, বাদলার কাক ডাকছে কোথাও, বাইরে চাকর বাকরের গলা শোনা গেল।
অবনী খাটের তলা থেকে চটিটা খুঁজে পায়ে গলিয়ে নিল। বাথরুমে যাবার আগে ঘরের দরজা খুলে চাকরকে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলল।
সামান্য পরেই ফিরল অবনী। ততক্ষণে মহিন্দর মশারি তুলে বিছানা পরিষ্কার করে দিয়েছে, ঘরের জানলার শার্সিগুলো একে একে খুলে দিচ্ছিল। অবনী অন্যমনস্কভাবেই দেখল, বাতাসে ময়দার গুঁড়োর মতন বৃষ্টির কণাগুলি এলোমেলো হয়ে উড়ছে।
চা নিয়ে এল নন্দ। জানলার কাছাকাছি টিপয়ে চা নামিয়ে রাখল, রেখে চলে যাচ্ছিল, অবনী পাখাটা বন্ধ করে দিয়ে যেতে বলল।
অন্যদিন এতক্ষণে সকালের নিত্যকর্মের অনেক কিছুই সারা হয়ে যায়, অবনী এ-সময় অফিস যাবার জন্যেও মোটামুটি তৈরি হতে পারে। আজ কোনও কিছুতেই আগ্রহ হচ্ছিল না। পট থেকে চা ঢেলে নিল অবনী, যৎসামান্য চিনি মেশাল। বাইরে সেই একই ধরনের বৃষ্টি।
এ বছরে এদিকে বৃষ্টি বেশিই হচ্ছে। গত বছর এতটা হয়নি। তবু এখন বর্ষার শেষ; মাঝ বর্ষায় অবনী রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। গত তিন মাস কাজকর্ম প্রায় কিছুই হয়নি। হবার উপায় ছিল না। প্রায় প্রত্যহ মুষলধারায় বৃষ্টি। শুরু হলে থামতে চায় না; একঘেয়ে ক্লান্তিকর কী বিশ্রী বৃষ্টি! মাঠ-ঘাট জলে জলময়, নদী-নালায় বান ডাকত, জঙ্গলে কাজ করা অসম্ভব ছিল। তার ওপর কুলিমজুরের অভাব; রাস্তা বন্ধ, মালপত্রও পাঠানো যেত না। লোকালয় ছেড়ে কোনও জঙ্গলে তাঁর পড়েছে। কুলিমজুরের, হঠাৎ দেখো ঝড়ে-জলে তাঁবু উড়ে গেল, চাল-ডাল ভেসে গেল জলে, মালপত্র তছনছ হল। ব্যাস, কাজ বন্ধ করে বসে থাক। অসুখ-বিসুখ, সাপ-বিছে, ভালুক-টালুক তো আছেই। এত রকম বাধাবিঘ্নের জন্যে এ সময় কাজ চলে মন্থর গতিতে। এবার আরও মন্থর। এই এলাকাটা পাহাড়ে জঙ্গলে নদীনালায় ভরা, এর মধ্য দিয়ে পথ পরিষ্কার করে খুঁটি পুঁতে পুঁতে ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন টেনে নিয়ে যাওয়া সময় সাপেক্ষ।
মাত্র দুবছর হল অবনী এখানে এসেছে। প্রথমে সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। সাবেকি কিছু কোদাল গাঁইতি শাবল কুড়ুল দড়িদড়া আর দেহাতি কিছু কুলিমজুর-জোয়ান গোছের দুচারজন পাঞ্জাবি, খাকি হাফপ্যান্ট পরা এক সুপারভাইজারবাবু। সবাই মিলে যা করছে তাকে। অসাধ্যসাধন বললেও অন্যায় হয় না। হীরালালের কাঁধে রাজ্যের বোঝা। তবু আশ্চর্য, ওই সাবেকি সম্পদ নিয়েও দেখতে দেখতে কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল।
অবনী নিজে ঠিক এ কাজের মানুষ নয়। তার আগের অভিজ্ঞতার বেশিটাই ছিল কাগজপত্রে। বিদেশি এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজে ডিজাইন করত। সাত ঘাটে জল খেত না। ওই কাজে বছর আষ্টেক কাটিয়ে হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এল এখানে। আসার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ছিল অনেক। মোটামুটি কারণটা এই যে, তার আর ভাল লাগত না, নিজের বৃত্তি বা পেশায় সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ওপরঅলাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, সহকর্মীদের সঙ্গে মনোমালিন্য দিনে দিনে বাড়ছিল। অসন্তোষ আর তিক্ততা, গ্লানি আর ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ক্রমেই একটা অসহ্য অবস্থা হল।