পরিচয় হল; সদ্য পরিচিতরা কেউ কারুর মুখ দেখতে পেল না। স্বভাবতই সৌজন্যসুলভ বাক্যালাপও নয়। হৈমন্তী শুধু গলা পরিষ্কারের শব্দ করল সামান্য। অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর তাকে বন্ধু হিসেবে পরিচিত করাল কেন! সে সুরেশ্বরের বন্ধু নয়, পরিচিত মাত্র; এবং এই পরিচয়ও এমন নয়, যাতে সুরেশ্বর তাকে পছন্দ করতে পারে। সুরেশ্বর কি উপকার পাচ্ছে বলে অবনীকে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করছে? নাকি এটা নিছক ভদ্রতা! অবনী কিছু বুঝতে পারল না। সুরেশ্বরের অনেক কিছুই বোঝা যায় না। যেমন এখন পর্যন্ত বোঝা গেল না, হৈমন্তী সুরেশ্বরের আত্মীয় কি না! মেয়েটি যে তার পূর্ব-পরিচিত, এবং সুরেশ্বরের স্বার্থেই এখানে এসেছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু স্বেচ্ছায় এসেছে, না সুরেশ্বর তাকে আনিয়েছে? কী সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে?
বর্ষায় এদিকের রাস্তাটা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। ভারী বাস চলে চলে কাঁচা রাস্তার দুপাশের অবস্থা নালার মতন হয়েছে, মাঝে মাঝে গর্ত, জল জমে আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে টাল খেয়ে জিপটা যাচ্ছিল। যেতে যেতে একবার কাত হয়ে উলটে যাবার মতন হল। হৈমন্তী টাল সামলাতে না পেরে আঁতকে ওঠার মতন শব্দ করল, সঙ্গে সঙ্গে তার হাত অন্ধকারে অবনীর পিঠের পিছনে এসে কিছু আঁকড়ে ধরল। কাঁধের কাছে অবনী হৈমন্তীর হাত অনুভব করতে পারল। হৈমন্তী তার সিটের ওপরটা ধরে আছে।
সুরেশ্বর বলল, এদিকে দুপুরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। …ওদিকে কেমন দেখলেন?
বিকেলে বৃষ্টি হয়েছে, আবার হচ্ছে হয়তো।
এরকম বৃষ্টিবাদলা মাথায় করে টাউন ছুটলেন? কাজ হচ্ছে নাকি?
অবনী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না; পরে বলল, আমাদের হীরালালকে চিনতেন?
সুরেশ্বর একমুহূর্ত ভাবল, হীরালাল! …ও, হ্যাঁ–চিনতাম।
ছেলেটি মারা যাবে।
সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকল।
অবনী খানিকটা সময় যেন জোর করে হীরালালের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিল: সেই জোর কোনও সিদ্ধান্ত অথবা সাহসবলে নয়; যেহেতু চিন্তাটা তাকে পীড়ন ও অসুখী করছিল, ভীত ও উদভ্রান্ত করছিল–সেহেতু অবনী সাময়িক কিছু সাধারণ সান্ত্বনা আশ্রয় করে দূরে সরে আসার চেষ্টা করেছে। এখন পুনরায় সে বেদনা ও কাতরতা অনুভব করল।
কী হয়েছিল? হঠাৎ? সুরেশ্বর শান্তস্বরে শুধোল।
অ্যাকসিডেন্ট অবনী বলল। খুব সংক্ষেপে হীরালালের দুর্ঘটনার বিবরণ দিল, শেষে বলল, কী বলবেন একে? ভাগ্য? ঈশ্বরের বিধান?
অবনীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক তিক্ততা ছিল। এই তিক্ততা তার পূর্বেকার ভাবপ্রবণতা নয়, ভীতিও নয়। কিন্তু এই তিক্ততার মধ্যে যেন সুরেশ্বরের মতন মানুষের প্রতি কোনও উপহাস ও বিতৃষ্ণাও আছে।
সুরেশ্বর নীরব। অবনীর দিকে না তাকিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে আছে। নির্জন নিস্তব্ধ মাঠ, ছোট ছোট ঝোপ, একটি-দুটি পলাশ কি তেঁতুল গাছ, জল জমেছে কোথাও, ঝিল্লিস্বর, ভেকরব, জলবিন্দু মেশানো দুর্বল জ্যোৎস্না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুরেশ্বর মৃদু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, সাধক-মানুষেই বলেছেন। বলেছেন: যাকে আমরা হারাই, সে আমাদের অন্দরমহলে কোথাও শুয়ে ঘুমিয়ে আছে–এরকম ভেবে নেওয়াই ভাল। তাকে ডাকাডাকি করে জাগাবার চেষ্টা অনর্থক। কান্নাকাটি আমরা করি, কিন্তু তাতে সে জাগে না। চেঁচামেচি করলে কিছু পাওয়া যায় না, শুধু প্রমাণ হয়, প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মের কথা আমরা কিছু জানি না, জেনেও বুঝি না।
অবনী বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করল না কথাটায়। মামুলি কথা। সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা। কিন্তু সুরেশ্বরের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর থেকে সে অনুভব করল, লোকটা বিচলিত হয়ে থাকলেও নিজেকে বেশ সংযত রেখেছে। সুরেশ্বরকে ঠিক এই মুহূর্তে অবনীর ঘৃণা হচ্ছিল। এরা শুধু ঘায়ের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘা আড়াল করে রাখে, রোগীকে দেখতে দিতে চায় না। অবনী বিরক্ত হয়ে উপহাসের গলায় বলল,–হ্যাঁ–সবই প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়ম৷ বলে হঠাৎ গাড়িটাকে জমা জলের বিশ্রী ডোবা থেকে বাঁচাতে ডান দিকে কাটিয়ে নিল। হেলে পড়তে পড়তে গাড়িটা মাঠে উঠে গেল। হৈমন্তী দুলে উঠে অবনীর কাঁধের কাছটা ধরে ফেলেছে। মাঠ থেকে আবার পথে নেমে অবনী বলল, গাড়িটা ডোবায় পড়লে আমরা উলটে যেতে পারতাম। হয়তো হীরালালের মতন আমাদের কেউ জখম হত, হাসপাতালে মরত। প্রকৃতির সেই অলঙ্ঘ্য নিয়মটা আপনি কীভাবে নিতেন?
সুরেশ্বরের কপালে সামান্য লেগেছিল। হাত বুলিয়ে নিল। বলল, জানি না। এখন তা বলতে পারব না। শান্ত সরল গলায় সে বলল, যেন অবনীর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে তার নেই। শেষে কী ভেবে, অনেকটা যেন স্বগতোক্তির মতন, অনেকটা যেন কবিতা আবৃত্তি করার মতন বলল, আকাশ ও পৃথিবী মানুষের শবাধার। সূর্য, চন্দ্র তার শবশয্যার সাজ, নক্ষত্রগুলি আমার গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া ফুল। সমস্ত জীব আমার শবযাত্রার সঙ্গী। মৃত্যুর কাছে সকলেই আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।
অবনী কেমন অন্যমনস্ক হল। শুনতে ভাল লাগল বলে, না-কি রুক্ষ ও নির্মম কিছু হঠাৎ আজ অন্য কোনও রূপে দেখা দিল বলে। কাব্য নাকি? অবনী শুধোল।
না কাব্য নয়, তবে কাব্যও হতে পারত। আপনি ভাববেন না কথাটা আমার। প্রাচীন এক চীনা দার্শনিক এই রকম বলেছিলেন। সুরেশ্বর আস্তে আস্তে জবাব দিল। অল্প থেমে আবার বলল, সংসারের সমস্ত জিনিস নিয়েই বাহুল্য করা যায়। জন্ম নিয়ে মৃত্যু নিয়ে, ভালবাসা নিয়ে, শঠতা নিয়ে সমস্ত নিয়েই। বাহুল্য যদি করতেই হয় তবে নিকৃষ্ট বাহুল্য করা কেন? নাটকটা খারাপ লিখে লাভ কী!