সামথিং কিছু! ঘাড় দুলিয়ে ভেঙচে দিল রিনি, চোখ বাঁকা করে বলল, কী যে এক মালুম মালুম করো। ছাতু কোথাকার!
তনু হেসে উঠল।
রিনিও মুখ ভেঙিয়ে বলল। আমাকে তো তখন খুব হালুম হলুম করলে, তুমিও বা কোন দেশের বাঘ?
চায়ের কাপটা তনু নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, তুমি ডাক্তার হলে রেপুটেশান হত। তোমার ট্যাবলেটটা ভাল। মাথা ধরা কমে এসেছে।
রিনি সামান্য চুপ করে থেকে জবাব দিল, বাবারই শখ ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। ডাক্তারি পড়লে আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হতাম। অন্য কিছু আমি হতাম না। আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হলে তোমার চোখ সারিয়ে দিতাম।
সরল মুখে হাসল তনু। ঠাট্টা করে নিজের কপালটা দেখাল। আমার কপাল খারাপ। বলে মুহূর্তখানেক পরে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশায় অনেকদিন মারা গেছেন, না?
বাবা! বাবা মারা গেছে অনেকদিন। আমার তখন তেরো বছর বয়েস। সাত বছর হতে চলল। রিনি ধীরে ধীরে বলল, অন্যমনস্কভাবে।
তনু বলল, আমার মা মারা গেছে আরও আগে। আমার সাত কি আট বছর বয়েস তখন। বলে তনু যেন উদাস মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, নীহারপিসি আমার মাকে দেখেছে।
রিনি যেন তার বাবার কথা ভাবছিল। বলল, আমার বাবার ছবি তুমি দেখেছ। মার ঘরে আছে, আমার ঘরে আছে। আমার বাবাকে দেখলে তুমি অবাক হয়ে যেতে। কেমন লম্বা চেহারা, গায়ের রং ধবধব করত। বাবা যা মজা করতে পারত না, কী বলব! বাবা নীচের তলায় বসে হাসলে ওপরে আমরা শুনতে পেতাম। কী ভাল মানুষ ছিল বাবা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
তনু রিনির কথা শুনতে শুনতে তার মার কথা ভাবছিল। তাদের বাড়িতেও মার ছবি আছে। মার কথা মনে পড়লে মার ছবির মুখটাই চোখের সামনে ভাসে। তনু বলল, আমার মার নাম ছিল পুষ্প পুষ্পলতা। মার রং ফরসা ছিল। মাথায় যা চুল ছিল–হাঁটু পর্যন্ত। লম্বা লম্বা চোখ। মা খুব বাইবেল জানত। আমায় কত গল্প বলত বাইবেলের।
রিনি বলল, তোমার মা কী করে মারা গেলেন?
তনু চুপ করে থাকল। তার চোখ-মুখের বিষণ্ণতা নজরে পড়ছিল। মাথার চুলে অন্যমনস্কভাবে হাত বুলিয়ে সে বলল, মার ডেলিভারি হচ্ছিল। কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, সাম কমপ্লিকেশানস। দুজনেই মারা গেল। আমি তখন খুব ছোট। আমার সব মনে নেই।
রিনি অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে তনুর কথা শুনছিল। তার পা নাচানো বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রিনি বলল, তোমার মা, আমার বাবা! অদ্ভুত, না?
তনু কিছু বলল না, রিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।
রিনি বড় করে নিশ্বাস ফেলল। আবার তার পা নাচানো শুরু হয়ে গেল। ঘাড়ের পাশ থেকে চুলের বিনুনিটা বুকের কাছে এনে হাতের ঝাঁপটায় দুলিয়ে খেলার মতন করল, তারপর হেসে ফেলে বলল, কী রকম মজা দেখো, আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা আর তোমার মা এখন স্বর্গে খুব গল্প করছে।
বলে রিনি থামল, যেন স্বর্গের সেই গল্প করার আসরটা উঁকি মেরে দেখে নিল; তারপর তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল, আর এখানে আমার মা আর তোমার বাবা তেতলায় বসে কথা বলছে। আমরাও বলছি–তুমি আর আমি। তিন জায়গায় তিন পেয়ার। কী অদ্ভুত, না?
তনু যেন খুব ধীরে মাথা দুলিয়ে জানাল, হ্যাঁ–বেশ অদ্ভুতই।