তনু রিনির দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমি অন্ধ হচ্ছি।
এবার রিনি যেন রাগ দেখিয়ে তনুকে ভেঙাল, বলল, অত শখে কাজ নেই। তুমি ফিলজফারই হও, তাও তো অন্ধ হওয়া।
নীহার ততক্ষণে এসে পড়েছেন। তাঁর পুজোপাঠ শেষ হয়েছে। গা ধুয়ে, কাপড়জামা বদলে, পুজো সেরে আসতে আজ তাঁর বেশি সময় লাগল না। তাঁকে খুব শুভ্র সতেজ দেখাচ্ছিল। তনুদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নীহার মেয়েকে বললেন, সারাদিন তুই কী যে হিহি করে হাসিস রিনি, দু দণ্ড শান্তিতে পুজো করাও দায় হল। অত হাসির কী হল?
রিনি বলল, যার পুজোয় মন থাকে সে হাসি শোনে না।
তুই থাম। আমায় জ্ঞান দিচ্ছে। আমি তোর পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।
রিনি হেসে ফেলল। পরে বলল, তোমার চা করে দিই। বলে রিনি উঠে পড়ল। চোখ দেখিয়ে এসে তোমার শ্যামের মাথা ধরে গিয়েছে। একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছি। এক কাপ চা খেতে চাইছে।
নীহার তনুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তোর মাথা ধরেছে?
তনু ঘাড় নাড়ল।‘ যা করে ডাক্তাররা চোখ নিয়ে, মাথা ধরতেই পারে। তা তুই জামাকাপড় পরে বসে আছিস কেন তখন থেকে? যা হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাক খানিকটা, ধকল কাটলেই সেরে যাবে। বলে নীহার আদর করে তনুর মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
রিনি আড়চোখে সেটা দেখল, দেখে চলে গেল। মার তনুশ্যাম এবাড়িতে এসেই মার কাছে তুই হয়ে গেছে। বলা যায় না, এরপর মা হয়তো তার শ্যামের মাথা টিপতে বসে যাবে!
তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীহার ডাকলেন, শ্যাম।
উঁ–
তোর চোখ ভাল হয়ে যাবে। কলকাতায় কত বড় বড় ডাক্তার আছে। তুই দেখ না, আমি সকলকে দিয়ে তোকে দেখাব। ভাবিস না। …যা হাতমুখ ধুয়ে নিগে যা।
তনু জামাকাপড় ছেড়ে, বাথরুম থেকে ফিরে এসে তার ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল। মাথার ব্যথাটা যে তার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে তা নয়, বরং রিনির কাছ থেকে অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে, ঠাণ্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে এখন তার আরামই লাগছিল। কিন্তু শরীরটা কেমন ক্লান্ত লাগছিল তনুর। চুপ করে শুয়ে ছিল। শুয়ে শুয়ে এই ঘর দেখছিল, তাদের ঘরবাড়ির কথা ভাবছিল, চোখের ডাক্তারের চেম্বার, গুপ্ত সাহেবের জাঁদরেল চেহারা, আরও কত কী তার মাথায় আসছিল। হঠাৎ রিনির গলা কানে এল।
চা নিয়ে এসে রিনি বলল, এই যে ফিলজফার মশাই, উঠুন; চা নিন; দেখুন চায়ে চিনি হল, না নুন হল!
তনু বিছানার ওপর উঠে বসে চা নিল। তার পা খাটের পাশে ঝুলছে।
চা দিয়ে রিনি চলে গেল না। মার চা সে ওপরে দিয়ে এসেছে; চা আর পান। মা বলেছিল। শরদিন্দুমামার ইসবগুলের শরবত তৈরি করে মা নিজে ওপরে নিয়ে গেছে আগেই।
রিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঠাট্টা করে বলল, চায়ে চিনি-নুন ঠিক হয়েছে?
তনু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, নাইস।
তা হলে তুমি চা খাও, আমি যাই।
বোসো না। তুমি এখন কী করবে?
গ্রাস কাটিং।
গ্রাস!
ঘাস কাটব। রিনির গলায় হাসির দমক উঠল।
তনু হেসে ফেলল। তুমি হরবখত তামাশা করো।
হরবখতই করি।
বোসো না। তনু আবার বলল।
রিনি বাস্তবিকই যাবার জন্যে আসেনি। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বসে বলল, আমি ঘাস কাটতে যাব শুনে তুমি ইয়ার্কি ভাবলে। জানো, আমায় গিয়ে এখন পড়তে বসতে হবে।
তনু অবাক হয়ে বলল, পড়তে বসা, আর ঘাস কাটা এক হল?
আলাদা হবে কেন! আমার কাছে দুই-ই সমান। আমি কি তোমার মতন স্টুডেন্ট? আমি বইয়ের পাতা খুলে কচকচ করে কাটব। ব্যাস…। পড়াশোনা আমার ধাতে সয় না। কী হবে পড়ে। আমার কাঁচকলা হবে। কারুরই কিছু হয় না আমাদের। এক্সামিনেশনের সময় কী টুকলি! সে-ঘটা তো দেখনি?
তনু হাসছিল। তুমি টোকো!
ওমা, টুকব না। কেনা টোকে! রিনি তনুর কথায় যেন একটু নাক সিঁটকে নিল।
তনু বলল, পেপারে দেখি, তোমাদের এখানে এক্সামিনেশনের সময় গোলমাল হয় বহুত?
রিনি বিনা প্রতিবাদে ঘাড় এক পাশে হেলিয়ে বলল, হয়। বহুত হয়। তোমাদের ওখানে হয় না?
হয়। কম হয়। তনু রিনির পা নাচানো দেখতে দেখতে বলল। রিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, পা নাচায় অনবরত। তনুর এই বদঅভ্যাস একেবারে নেই। সে চুপচাপ বসে থাকার সময় মাঝে মাঝে ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে দাঁতে নখ কাটে। তনু এবার জিজ্ঞেস করল, তোমার সাবজেক্ট কী?
আমার আলাদা কোনও সাবজেক্ট নেই। অনার্স-ফনার্স নেই, স্যার। আমার শুধু পাস।
অনার্স নাওনি?
আহা নিতে চাইলেই দিত আর কী! আমি চাইনি, ওরাও দেয়নি। লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই। কী হবে আমার পড়ে! আমি দিদিমণিও হব না, চাকরিও করব না।
তনু হেসে ফেলে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?
রিনি এমন সহজ প্রশ্নটা আগে নিশ্চয় ভেবে নেয়নি৷ জবাব দেবার সময় হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, কিছুই করব না। বলে একটু থেমে কী যেন ভাবল, বলল, বাবা থাকলে আমার এত সুখ আর হত না। আমায় ডাক্তারি পড়তে হত। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। হয় আমায় ডাক্তারি পড়তে হত, না হয় বায়ো-কেমিস্ট্রি। বাবা বলত, আমাদে দেশে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে কেউ ভাবে না। আমি বাবা, বায়ো-কেমিস্ট্রি যে কী তা একেবারে জানি না।
তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি মিলিয়ে সামথিং কিছু হবে। মালুম, ইট ইজ রিলেটেড টু মেডিক্যাল সায়েন্স।