সুরেশ্বর বলল, বেশি দূর নয়, কাছেই; মাইল খানেকের সামান্য বেশি। একা হলে আমি হেঁটে চলে যেতাম। মেয়েটির জন্যে বিপদে পড়েছি, সঙ্গে কিছু মালপত্রও রয়েছে।
অবনী বিশেষ প্রসন্ন হল না। সুরেশ্বরকে তার আশ্রমে পৌঁছে দেওয়া অবনীর দায়িত্ব নয়। তা ছাড়া এতটা পথ–শহরে যাওয়া এবং ফিরে আসায় সে ক্লান্তি অনুভব করছে। তবু, বিপন্ন এক মহিলার কথা ভেবে অবনী সুরেশ্বরের অনুরোধ এড়িয়ে যাওয়ার কৈফিয়ত খুঁজে পেল না। তার বিরক্তিও প্রকাশ করল না, নিস্পৃহ গলায় শুধু বলল, আসুন তা হলে..একটু তাড়াতাড়ি।
সুরেশ্বর আর দাঁড়াল না, বাসের দিকে চলে গেল।
অবনী চুপচাপ বসে সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে পাশ ফিরে বাসের দিকে তাকিয়ে থাকল! জ্যোৎস্না অনাবিল নয়, তবু দেখা যায় সব। বাসের ড্রাইভার ইঞ্জিনের ঢাকা খুলে যন্ত্রপাতি দেখছে, হাতে লণ্ঠন নিয়ে তার পাশে অন্য একজন দাঁড়িয়ে। বাস থেকে নেমে পড়ে একদল দেহাতি এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে, বিড়ি ফুকছে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ পানটান খাচ্ছে। বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ায় এদের তেমন কোনও ব্যাকুলতা আছে বলে এখন অন্তত মনে হচ্ছে না।
অবনীর চোখে পড়ল, বাসের পিছন দিকে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। হয়তো এতক্ষণ বাসের মধ্যেই বসে ছিল, সুরেশ্বরের কথামতন নীচে নেমে এসেছে। সামান্য দূর থেকে স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখা গেল না। অনুমান করা গেল।
কৌতূহল অনুভব করল অবনী। বৃদ্ধা অথবা বয়স্কা বলে মনে হচ্ছে না। সুরেশ্বর বলেছিল মহিলা: অবনীর ধারণা হয়েছিল, বৃদ্ধা বা বয়স্কা। পরে সুরেশ্বর বলেছে মেয়েটি; অবনী তখন তেমন খেয়াল না করলেও ঠিক এই ধরনের কোনও মেয়ের কথা ভাবেনি। সুরেশ্বরের কোনও আত্মীয়া নাকি? এই বনজঙ্গলের মধ্যে তার আশ্রমে একটি মেয়েকেই বা সে টেনে আনবে কেন?
মেয়েটি তফাতে দাঁড়িয়ে অবনী গাড়ির দিকে তাকিয়েছিল, তারপর বাসের দরজার কাছে সরে গেল আবার। বোধ হয় সুরেশ্বরকে জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করতে গেল।
সুরেশ্বরই প্রথমে একটা সুটকেস এনে গাড়ির পিছন দিকে রাখল। বলল, বাক্স বেডিং আর কাঠের পেটি আছে একটা, কিছু খুচরো-খাচরা জিনিসও।
দুটি দেহাতি ধরাধরি করে বাক্স বেডিং এনে ফেলল গাড়ির মধ্যে। সম্ভবত এরা সুরেশ্বরকে চেনে। কথাবার্তা থেকে সেই রকম মনে হল। জিপের পিছনের কাটা-দরজাটা খোলা অসুবিধেজনক বলে কোনও রকমে চাপিয়ে দিল।
শেষে পেটিবাক্স, আর পিছু পিছু সুরেশ্বর ও সেই মেয়েটি। দুজনের হাতেই খুচরো জিনিসপত্র: ছাতা, মেয়েলি কাঁধব্যাগ, টর্চ, জলের ফ্লাস্ক।
অবনী বলল, এদিক থেকে উঠুন। …গাড়ির পেছন দিকটা ভিজে থাকতে পারে, দেখে নিয়ে বসবেন। বলে সে সামনে দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিল।
সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি ওঠো। সাবধানে। এই নাও, চর্ট জ্বেলে একবার দেখে নিয়ো।
হেম মাথা নিচু, পিঠ কুঁজো করে টর্চ জ্বেলে গাড়িতে উঠছিল। অবনী তাকে অনেকটা স্পষ্ট করে দেখতে পেল। হেম যখন আসছিল, কাছে এসে গাড়ির সামনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়েছিল, অবনী সঠিকভাবে কিছু অনুমান করতে পারেনি। হেম যুবতী, দীর্ঘাঙ্গী, তার সাজসজ্জা শহুরে এইমাত্র বুঝতে পেরেছিল। এখন, হেম যখন টর্চ জ্বেলে, অবনীর গায়ের পাশে পিঠমাথা নুইয়ে গাড়ির পেছনের দিকটা দেখছে কোথায় বসবে ভেবে নিচ্ছে–তখন অবনী চকিতের জন্যে যেটুকু দেখল, তাতে বিস্মিত হল। কী যেন অবনীকে আকর্ষণ করল, এক ঝলক ফুলের তীব্র গন্ধ সহসা অ-স্থানে অন্যমনস্ক পথচারীকে যেমন আকর্ষণ করে অনেকটা সেই রকম।
হেম পিছনে গিয়ে বসল।
অবনী সুরেশ্বরকে ডাকল, আপনি সামনে আসুন। দোমড়ানো সিটটা সোজা করে দিল। সুরেশ্বর উঠে এল।
গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে অবনী বলল, আমি আপনার রাস্তা চিনি না, চিনিয়ে দেবেন।
সুরেশ্বর বলল, সামনে এগিয়ে ডান দিকের রাস্তা।
বাসটা খারাপ হয়েছিল ঠিক তেমাথা একটা মোড়ে। হয়তো আরও সামান্য আগেই ওটা বিগড়েছিল, সকলে মিলে ঠেলেঠুলে একেবারে মোড়ে এনে রেখেছে। অবনী এ বিষয়ে তেমন কোনও আগ্রহ বোধ করল না, গাড়ি ঘোরাল।
সুরেশ্বর কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। …বাসটা স্টেশন ছাড়ার পর থেকেই গোলমাল করছিল।
এটাই তো শেষ বাস?
হ্যাঁ। আমাদের দিকে যাবার শেষ বাস…আপনি কি টাউনে গিয়েছিলেন?
অবনী হ্যাঁ বলল। সুরেশ্বরদের রাস্তা পাকা নয়, চওড়াও নয়। পাথুরে পথ। অবনী শুনেছে, এই রাস্তা খুবই কম, মাইল দেড়েক বড় জোর। সারা দিনে দুতিনটে মাত্র বাস স্টেশন, টাউন এবং ফুলগিরের দিকে যাবার পথে এই পথটুকু পাক দিয়ে আবার ফিরে যায়। অর্থাৎ যে বাস যায় তাকে আবার সামান্য পরেই এই পথ ধরে ফিরতে হয়।
গাড়ি বেশ লাফাচ্ছিল। পিছনের সিটে ঝাঁকুনি খেয়ে হেম কেমন একটু শব্দ করে উঠল। সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে হেমকে লক্ষ করে বলল, কিছু একটা ধরে থেকো। ওষুধের বাক্সটা আলাদা আছে তো?
ওপরে রেখেছে, হেম বলল। হেমের গলার স্বর পরিণত, ভরা-ভরা।
সুরেশ্বরের যেন হঠাৎ খেয়াল হল কিছু। সরল, সরস গলায় অবনীকে বলল, নতুন মানুষটির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম হৈমন্তী, আমরা বলি হেম। হৈমও বলে কেউ কেউ। চোখের ডাক্তারি পাশ করেছে। এখানে নিয়ে এলাম। বলে সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে উদ্দেশ করে বলল, হেম, ইনি আমাদের বন্ধুবিশেষ, অবনীবাবু–অবনীনাথ মিত্র। এখানেই থাকেন। ওঁর কনস্ট্রাকশান দেখা শোনার কাজ, ইঞ্জিনিয়ার মানুষ।