তনু বলল, চা পেলে গ্র্যান্ড হয়।
হয় ঠিকই; কিন্তু তোমার পিসি তোমায় হরিণঘাটা খাওয়াতে চাইবে।
তনু বুঝতে পারল না। হরিণঘাটা কী?
হরিণের দুধ, রিনি মুখটা গম্ভীর করে বলল, কলকাতায় আমরা হরিণের দুধ খাই। বলে মুহূর্ত পরে গাম্ভীর্য হারিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার মানুষকে যা ছোটছুটি করতে হয় তাতে গোরুমোষের দুধে চলে না, বুঝলে।
তনু ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে হেসে ফুলেছিল: বলল, তুমি হরিণ দেখেছ?
অনেক।
কোথায় দেখেছ?
চিড়িয়াখানায়।
আমি হরিণের জঙ্গল দেখেছি। মোস্ট বিউটিফুল।
রিনি চোখের তারা বেঁকা করে নিরীহ গলায় শুধোল, হরিণের জঙ্গলে কারা থাকে।
তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কারা?
মানে কী থাকে? শুধু হরিণ?
না শুধু হরিণ কেন! আরও জীবজন্তু থাকে। হরিণ বেশি।
তা হলে আর হরিণের জঙ্গল বলছ কেন, বলো জঙ্গলের হরিণ। বনে থাকে বাঘ, খাটালে থাকে মোষ, বলতে বলতে রিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তনুও হাসতে লাগল।
রিনি এবার অন্য কথা পাড়ল। পার্ক স্ট্রিটে তো গেলে চোখ দেখাতে: পার্ক সার্কাস কেমন লাগল?
তনু সকৌতুকে বলল, জাস্ট লাইক এ সার্কাস। গ্র্যাঞ্জার, ডেকোরেশান, লাইট, শো।
ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি নয়। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাবার সময় আমি দেখেছিলাম। আসবার সময় চোখের যা হাল, চাইতে পারছিলাম না। বড় ভিড়, আর শব্দ।
বাঃ, সার্কাসে ভিড় হবে না। ওটা সাহেবপাড়া। তুমি যদি বড়দিনের সময় আসতে পার্ক সার্কাসের চেহারা দেখতে।
তনু তার দু হাত ঘাড়ের তলায় রেখে খানিকটা আরামের চেষ্টা করল। বলল, বাবা তোমাদের কলকাতা দেখে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাবা যখন কলকাতায় থাকত স্টুডেন্ট লাইফে–তখন কলকাতা এরকম ছিল না। বাবা পিসিকে বলছিল, কলকাতার রাস্তায় বেরুলেই দম আটকে আসছে। বাবার।
মজার চোখ করে রিনি জিজ্ঞেস করল, তোমারও দম আটকে যাচ্ছে নাকি? তা হলে আগেভাগেই বলে রাখো, বাবা! এরপর তোমায় কলকাতা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমি ফ্যাসাদে পড়ব নাকি?
তনু ঘাড় নাড়ল। আমার দেখতে ভাল লাগে বহুৎ। কিন্তু ক্রাউড দেখলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই। আমার চোখের নার্ভগুলো সহ্য করতে পারে না, কেমন একটা ফিলিং হয়। বলতে বলতে তনু থামল, হঠাৎ বোধহয় কপালে তীব্র ব্যথা এসেছিল, চোখ বুজে কপাল কুঁচকে ব্যথাটাকে সে সইয়ে নিল। তারপর বলল, তোমাদের কলকাতায় ডবল ডেকার বাসগুলো দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি সব চাপা পড়ল।
রিনি যেন তনুর ওপর করুণা করে হাসল। বলল, তুমি একেবারেই গাঁইয়া।
ট্রাম দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে–তনু বলল, ভেরি নাইস। আজ আমরা যখন যাচ্ছিলাম, আসছিলাম–গাছপালার গা দিয়ে মাঠের পাশে পাশে ট্রাম যাচ্ছিল। খুব নাইস লাগছিল।
রিনি হাসল খানিকটা। বলল, তোমায় কলকাতা দেখাতে নিয়ে আমিই পড়ব বিপদে। তোমার যে কোনটা নাইস হবে আর হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কে জানে! কলকাতার ট্রাফিক পুলিশও তোমার কাছে নাইস হয়ে যাবে হয়তো, কে জানে!
আমায় আগে তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামটা দেখাও।
গেলেই হল একদিন, কাগজটা সকালে দেখে নিতে হবে, রোজ খোলা থাকে না।
তনু রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, খানিকটা অন্যমনস্ক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি, বুঝলে রিনি, আমার খুব ইচ্ছে ছিল অ্যাস্ট্রনমি পড়ব। ছেলেবেলা থেকেই আকাশ, তারা, ওই এন্ডলেস স্পেস দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। ইট অ্যাট্রাক্টস মি। আমার চোখের জন্যে আমি আকাশটাও ভাল করে দেখতে পেতাম না। তবু আমার ভীষণ ভাল লাগত। খালি চোখে আমরা দু হাজারের মতন তারা দেখতে পাই, বুঝলে। আমি কত পেতাম কে জানে। পাঁচশো, সাতশো হয়তো। একটা তারা আছে সাড়ে ছশো লাইট-ইয়ার দুরে, তার মানে এখান থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে, সেই তারাটা আমাদের সুর্যের চেয়ে একানব্বই হাজার গুণ আলো ছড়ায়। তুমি ইমাজিন করতে পারো? কত দূর থেকে এই আলো আসছে ভাবলে গায়ের মধ্যে তোমার শিউরে ওঠে না? আমার গা শিউরে যায়…বুঝলে রিনি, আমাদের এই জগৎটাই কত বড়, কত রকম মিষ্ট্রি এর মধ্যে। কিন্তু ওই যে মাথার ওপর এটারন্যাল স্পেস ওটা আরও মিস্টিরিয়াস। ভাবাই যায় না। তোমায় একটা কথা শোনাই, প্রতিদিন ওখানে কত কী ঘটে যাচ্ছে ভাবতে পারবে না। ওখানে–ওয়ান্ডর্স ইন দি মেকিং, ওয়ার্ডস ডেড অ্যান্ড অ্যারিড, হোয়ারলিং ফ্রাগমেন্টস অব ওয়ান্ডর্স–অল পাস অ্যাবাভ আস ফ্রম নাইট টু নাইট।
রিনি তনুর মুখ দেখছিল। তনু যতটা পেরেছে চোখের পাতা খুলে ফেলেছে কথা বলতে বলতে, মুখটি যেন আবেগে ভরে উঠেছে। গলার স্বর বড় সুন্দর। রিনি বলল, তুমি অ্যাস্ট্রনমি পড়লে না কেন?
এই চোখ নিয়ে? চোখের জন্যে আমার পড়াশোনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তনু একটু থামল, তারপর আবার বলল, বাবা বটানির প্রফেসার, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি বটানিটা যদি পড়তে পারি। তাও হল না।
তুমি এখন কী পড়ছ? ফিলজফি।
রিনি মুখ হাঁ করে চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত এক মজার ভঙ্গি করে বলল, দর্শন! ও বাব্বা, তাই বললা; তুমি হলে ফিলজফার। তাই তোমার মুখে অত জ্ঞান। রিনি হাসতে লাগল।
তনু কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে চুপ করে গেল। তার মুখেও স্নান হাসি।
রিনি বেশ নজর করে তনুকে দেখল। ঠাট্টাটা তনু ভাল মনে নেয়নি। কী ছেলে রে বাবা! রিনি বলল, বড় হয়ে তুমি তা হলে ফিলজফার হচ্ছ?